গত শতকের নয়ের দশকে সন্ত্রাসদীর্ণ আসামের মাজুলি অঞ্চলে সমাজকল্যাণমূলক স্বেচ্ছাসেবী কাজে আত্মনিয়োজিত ছিলেন মেধাবী উন্নয়নকর্মী সঞ্জয় ঘোষ। সঙ্গে তাঁর সহধর্মিনী সুমিতা ঘোষ ও তাঁদের সহযোদ্ধারা। ষোলোমাসের সেই উদ্দীপক কাজকর্মের অবসান হয় সঞ্জয় ঘোষের অপহরণের পর। যে মাজুলিকে সে চিনত নিজের প্রতিটি রোমকূপের মতো, যে মানুষদের ভালবাসত নিজের সন্তানের অধিক তাদের সকলের কাছ থেকে কোনও খবর এল না। নৃশংস হত্যার পর মানুষ ভয়ে যেভাবে বোবা হয়ে যায় তেমনই উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ে প্রকৃতি। পাখি গান গায় না, সন্ত্রাসের হাওয়ায় মাথা দোলায় না দ্বীপের গাছপালা। কেবল নিঃশব্দে পাড় ভাঙে আর জল আরও ঘোলা হলে বুঝি বিচ্ছিন্নতাবাদী উগ্রপন্থীরা অপহরণের পর গুপ্তহত্যা করে উল্লাসে আর দেহটি বস্তাবন্দী করে ভাসিয়ে দেয় ব্রহ্মপুত্রের জলে।
ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় পৃথিবীর বৃহত্তম নদীঘেরা দ্বীপ মাজুলি মহাপুরুষ শঙ্করদেব ও মাধবদেবের বৈষ্ণব ধর্মের প্রাণকেন্দ্র। আসামের আধ্যাত্মিকতা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির মূল ধারাটি এখান থেকে বিকশিত হয়েছিল। যোগাযোগ আর উন্নয়নের অভাবে, বিধ্বংসী বন্যা আর নিয়মিত ভূমিক্ষয়ের দুর্বিপাকে জেরবার এই দ্বীপ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বর্ণময় বৈচিত্রের এই অনুবিশ্বে প্রধানত মিসিং ও নানা উপজাতীয় মানুষের বসবাস, যদিও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও কম নয়। সঞ্জয়ের বিভিন্ন লেখায় আসাম তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের এক চলমান দর্পণের সঙ্গে সেই উপদ্রুত সময়ের আর্তস্বর, বিষাদ ও উদ্বেগের অন্তর্ধান ও অন্বেষণ প্রচেষ্টা এই বইতে সাজিয়ে দিয়েছেন শ্রীমতি সুমিতা ঘোষ।
২য় ব্লার্ব
সঞ্জয়ের সংকলিত লেখার সঙ্গে সুমিতা যোগ করেছেন নিজের অনুভূতি ও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ। সুমিতা স্বামী সঞ্জয় ঘোষের সঙ্গে কাজ শুরু করেন ১৯৮৪-৯৩ সালে পশ্চিম রাজস্থানের উন্নয়ন সংস্থা URMUL ট্রাস্টের সঙ্গে। তাঁদের কাজ ছিল এলাকার আর্থ সামাজিক পরিবর্তন ঘটানো। সেই প্রকল্প বাস্তবায়নের পর ১৯৯৬ সালে সুমিতা স্বামী সঞ্জয় ও দুই সন্তান সহ মাজুলি দ্বীপে চলে আসেন উন্নয়নের বিবিধ পরিকল্পনা নিয়ে। ULFA কর্তৃক সঞ্জয় অপহরণের পর দিল্লি ফিরে এসে ২০০৬ সালে রংসুত্র নামে এক সংগঠন তৈরি করেন। যারা ভারতবর্ষের নানা গ্রামের উৎপাদন ও শহরের চাহিদার মধ্যে যোগসূত্র ও ভারসাম্য রক্ষা করে। সুমিতা একজন দক্ষ যোগ প্রশিক্ষক।
Sanjoy’s Aassam: Daires and writings of Sanjoy Ghose বইটির প্রাঞ্জল অনুবাদ করেছেন কবি মনোতোষ চক্রবর্তী অসীম মমতায়। দলিত সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ, হিরেণ ভট্টাচার্য ও নীলমণি ফুকনের কবিতা ছাড়াও তিনি সাহিত্য একাদেমি প্রকাশিত নির্মল প্রভা বরদলৈ-এর ‘সুদীর্ঘ দিন আর ঋতু’ কাব্যগ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেছেন। আলোকচিত্রী ধ্রব দত্তর গত এক দশক জুড়ে তোলা মাজুলি চরের প্রাণময় বাস্তবচিত্র বইটিকে করে তুলেছে সমকালীন।