উনবিংশ শতকের শেষ দিকে মেয়েদের স্কুল অবশ্য নেই নেই করেও
ছিল না যে তা নয়। অবলাবান্ধবেরা পা রেখেছেন নবজাগৃতির চালচিত্রে। বিদ্যাসাগর মশাই
সবে লিখে উঠেছেন বিধবাবিবাহ প্রবর্তন বিষয়ক প্রস্তাব। আর তাঁর নামে কুৎসায় কান
পাতা যাচ্ছে না। মিসেস কুক ফিরে যাচ্ছেন ভগ্ন হৃদয়া। কুলকামিনীরা লিখছেন ‘মনোত্তমা’
হয়ে উঠবার কথা।
আর দাশু রায় বলছেন, বাল্য হতে বন্দীশালে
মানুষকে পাঠশালে/ লিখতে দেয় না, কেন জান কান্তা/ যদি লেখাপড়া
শিখতে লুকিয়ে লুকিয়ে পত্র লিখতে/ঘটত ভাল পীরিতের পন্থা। শিক্ষার দাসীবৃত্তি করলেও
নাটক-নভেল পড়া পর্যন্ত টানা ছিল সীমানা। তবু যে দুচার ছত্র তাঁদের লেখা
চিঠিচাপাটির গণ্ডি টপকে বাইরে আসছিল সেইসব আঁকিবুকি ল্যাখাজোখাকে ধর্তব্যে না আনাই
ছিল দস্তুর। বেথুন ইস্কুলের গাড়ির গায়ে বিদ্যেসাগরমশায় বড় বড় হরফে লিখে দিয়েছিলেন ‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীরাতিযত্নত’।
এই
সব সেই সেকালের কথা, যখন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ডাকে সাড়া দিয়ে উত্তর ও
পূর্ববঙ্গের বন্যা, ঝড়ের জন্যে চাঁদা সংগ্রহ করতে বেরিয়ে
এলেন সোনাগাছি, রামবাগান চাঁপাতলা, আহিরীটোলা
জোড়াসাঁকো, সিমলা, কেরানিবাগান, ফুলবাগানের পতিতারা, তাঁদের পরণে লাল পাড় গেরুয়া
শাড়ি, কপালে লাল টিপ’।
বটতলার
বইতে তখন প্রোটাগনিস্ট স্ত্রী চরিত্রেরা রবিঠাকুরের গান গাইতে শিখছে কেবল। কলকাতার
নাট্যমঞ্চ তখন কাঁপাচ্ছেন দুই বিবি, মিস গ্রেগ আর মিস এলিস।
ইতিহাস আসলে ব্যাটাছেলেদের লেখা ব্যাটাছেলেদের জয়জয়াকারের গল্প। সেই গল্প শোনানোর জন্যে উৎসাহী বা জ্ঞানীগুণীর সংখ্যার কমতি নেই। কিন্তু ঘোমটার আড়ালে বা ঘোমটা খসিয়েছে যে মেয়েমানুষেরা তাঁদের নিজেদের কথা বলতে চেয়েছেন, তাদের বোধভাষ্য নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যথা আজও নেই। ১৮০০ থেকে ১৯০০-র নানাবিধ নাগরিক ‘জঞ্জাল ঘেঁটে’ উনিশ শতকীয় কলকাতার বৃত্তান্ত সরেজমিন ফিরে দেখলেন পূর্ণা চৌধুরী। ‘গড়গড়ার মা’লো’ দুইটি ধারার বুনোটে ‘অন্য’ ইতিহাস। অন্য ভাষায়, অন্য মেজাজে বলা। সে কথা অকপটে স্বীকার করে লেখক বলছেন—সত্য বই মিথ্যা বলিব না। অনেকদিন ধরেই ভেবেছি মেয়েদের দেবী অথবা দানবী সাজানোর যে খেলা সেই মধ্য যুগ থেকেই চলে এসেছে সাহিত্য এবং ইতিহাসে, তার বাইরে একটা ব্যতিক্রমী সন্ধান শুরু হওয়া দরকার। বলাটা সহজ। কার্যকালে সমুৎপন্নে সে বড় জটিল ব্যাপার। সেই যে শরৎবাবুর শ্রীকান্ত বলেছিল ‘লাও তো বটে, কিন্তু আনে কে’, সেই বৃত্তান্ত। লাজ -লজ্জা ভয় জয় করতে খানিক সময় গেল, তার পর বসে পড়লাম। দেখলাম রসদ খুব কম নয়, দুই এক কথা শুরু করতে যথেষ্টর একটু বেশি। লিখতে লিখতে শিখেছি, পড়তে পড়তে লিখেছি, এইভাবেই কাজ এগিয়েছে। যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে বসেন এ লেখা নারীবাদী সমীক্ষা কিনা, আমি বলব ‘না’, এ হল একটা ভিন্ন বাচনের খোঁজ, পুরুষমুখী ইতিহাস গ্রন্থনার ছকের বাইরে এক প্রতিবাদী সমান্তরাল কথন। এ বইয়ে আছেন দেবী এবং দাসীরা। আছেন কিছু পুরুষও। পুরুষরা মাথায় থাকুন, আমি অধম মেয়েমানুষ, দেবী আর দাসীদের সঙ্গে গলা মেলালাম, তাদেরই ভাষা, তাদেরই ভঙ্গি রপ্ত করে। মেয়েদের ‘বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না’ এ প্রবচনটি যে একটি পাখি পড়ানো মিথ্যে, তা প্রমাণিত হোক। গড়গড়ার মা ’লো ঊনবিংশ থেকে বিংশ শতকের নারীবাদী ইতিহাস, না মেয়েমানুষদের কথা, সেটা পাঠকরা স্থির করুন। সে বিচার তাঁদের। আমি শুধু বলি, ‘আমার রাধা শক্তি সঞ্চারিল নইলে পারব কেন?’।
পূর্ণা চৌধুরী
জন্ম১৯৬১, কলকাতা। প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক। স্নাতকোত্তর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় এবং কার্লটন ইউনিভার্সিটি, অটোয়া। কিছু সময় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা। ১৯৯৫ থেকে কানাডার অটোয়া শহরে বসবাস। পেশায় ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা। নেশা: বই, টুকিটাকি লেখা, রবীন্দ্রনাথের গান, রান্নাবান্না।
আগের বই- পূর্ণলক্ষ্মীর একাল-সেকাল
আলোচনা/ সমালোচনাগুলি পড়তে ছবির উপর ক্লিক করুন।
আজকালে প্রকাশিত সমালোচনা ১৩ অক্টোবর ২০১৯ সম্পুর্ণ পড়তে ক্লিক করুন এইখানে। লিখেছেন শবরী রায়।
‘হাত ঝাড়লেই পর্বত’ এই প্রবাদ প্রবচনটি শুনেছেন? দেওয়ানচি, বুব্বুলিয়াদের সম্পর্কে জানেন? আঠারশো শতকে তৈরি হওয়া সমাজের শ্রেণীচরিত্র মনে আছে তো? বঙ্কিমের লোকরহস্য থেকে পূর্ণা তুলে দিয়েছেন, ‘যাঁহার বাক্য মনোমধ্যে এক, কথনে দশ, লিখনে শত এবং কলহে সহস্র তিনিই বাবু, যাঁহার বল হস্তে একগুণ, মুখে দশগুণ, পৃষ্ঠে শতগুণ এবং কার্যকালে অদৃশ্য তিনিই বাবু… যাঁহার স্নানকালে তৈলে ঘৃণা, আহারকালে আপন অঙ্গুলিকে ঘৃণা এবং কথোপকথনকালে মাতৃভাষাকে ঘৃণা তিনিই বাবু৷…’ আরও কত কি…
উসকে দিয়েছেন পলতে, আমি উলটে চলেছি৷ মেয়ে মানুষের ফাঁদি নথ আঁঁকশি হয়ে পুুরুষমানুষকে নাকানিচোবানি খাইয়ে ছাড়ে৷ মদ কোন রাস্তায় এসে বাবুসমাজে জায়গা করে নিল, ১৮৬০ সালে বটতলায় ছাপা হরিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘কলির রাজ্যশাসন’ ছড়াকারে তা দেখাচ্ছে। আবার বঙ্কিমচন্দ্রের বাবুতত্ত্বের ছেঁদাও দেখা যাচ্ছে৷ এইসময় পিলপিল করে কিছু বাঈজি বারাণসী, লক্ষ্ণৌ, মহিশূর, মুর্শিদাবাদ থেকে এসে জড়ো হয়েছেন। এসেছেন সাহেবদের তাড়া–খাওয়া গুটিকয়েক নবাব সুলতান গোছের লোক৷ মাসমাইনের বাঁধা হাজার টাকার নিক্কিবাঈ থেকে শুরু করে হরিমতি বাঈ কিম্বা দেবী বাঈয়ের মতো কিছু হিন্দু মেয়েও বাঈ হিসেবে নাম কিনেছিলেন। এছাড়াও ছিল বাড়ির নিকট এবং লতায় পাতায় নিরাশ্রয় অনাথ বিধবা এবং পতিপরিত্যক্তা সধবারা৷ এছাড়াও উড়েনি, নাপতিনি, মালিনী, নেড়ি (বোষ্টমী) দাসীরূপাদের শরণাপন্না হতেন এক্সেস সাপ্লাইয়ের জন্য। কলকাতার বাজারে যেন আর লঘুগুরু রইল না৷ লেখিকা পরিসংখ্যান দিচ্ছেন, ‘অন্দরমহলের ১৮৫৩–র হিসাব অনুযায়ী কলকাতা শহরে তখন সাড়ে চার লক্ষ জনসংখ্যার বারো হাজারই বেশ্যা। তার মধ্যে দশ হাজারের কাছাকাছি কুলীন সধবা অথবা অল্পবয়সী বিধবা৷ অন্দরমহলের এনারা হলেন নন রেজিস্টার্ড উদ্বৃত্ত।’
কেন পড়বেন? ওই যে প্রথমেই বললাম, নিজেকে উসকে দেওয়ার জন্য৷ আলো খুঁজে পাবেন৷ অন্ধকারও৷ হাতড়ে নিজেই আর একটা সলতে জ্বালাতে পারবেন৷ তেমন কল্পনাশক্তি থাকলে আপনিও লিখে ফেলতে পারেন এক ঐতিহাসিক উপন্যাস। পাঠক আপনি যদি অবলা হন, তাহলেও পড়ুন, অবলাবান্ধব হলে তো পড়বেনই, সবল এবং সবলারাও পড়ে দেখতে পারেন৷ উপহার দিতে পারেন৷ একটি সংগ্রহযোগ্য বই৷ হাতে নিয়ে সুন্দর অনুভূতি হল৷ পার্থ দাশগুপ্তর প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ যথাযথ এবং দৃষ্টিনন্দন৷ বইটিকে একটি অ্যালবামও বলা যেতে পারে। প্রকাশক সামরান হুদা তথা ৯ঋকাল বুকস৷