এই বই বিষণ্ণতার কুয়াশায় মোড়া এক জনপদের আত্মকথা। সীমান্তবর্তী এক মফস্বল তার সমস্ত মুদ্রাদোষ নিয়ে ডালি সাজিয়েছে এক বিষাদবিদীর্ণ ছোটবেলা, যৌবনে আলোড়িত সত্তরের দশক—মুক্তির দশকের সন্ত্রস্ত রিফিউজিরা স্বাদ-গন্ধ সহসা বদলে দিলে ইচ্ছাময়ী ইছামতী লীলাক্রীড়ায় গুটিয়ে নিচ্ছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দ্বীপগুলি। এইভাবেই হারায় মেয়েটি তার প্রিয়জনদের। সে শিখেছে এই সমস্ত টুকিটাকি ওঠাপড়া যেন সহজে গায়ে না লাগে। সে বড় হওয়ার আকাঙ্খায় মুখ লুকায় বাংলা সাহিত্যের পাতায় পাতায়, কিন্তু আকাশে তখন থমকিয়ে ছিল মেঘ। সুতরাং আসে মেঘদূতম, গাছে আসে নতুন পাতা ও প্রেম।
ছেলের আকস্মিক প্রয়াণে মা, লিখতে শুরু করেন তার না বলা যত একরত্তি জীবনের গল্প, টুকিটাকী কুজ্ঝটিকা। এক পৃথিবী লিখতে লিখতে তার দৈবী ভর হলে উন্মীলন হয় দিব্যচক্ষুর, দশখানি হাত হয় তাঁর। একদা দেখেন গাছেরা ক্রমাগত লিখেছে, নতুন পাতা কুড়ি ও ফল। নদী লিখেছে তার অগণিত উচ্ছ্বাস আর ঢেউ, জাল টপকানো মাছেদের গল্প, ইতিউতি জেগে ওঠা এইসব মাছরাঙা দ্বীপ। তবুও এই লেখা চরম হতাশার, না খেয়ে চুরি করতে শেখার মতো সত্য আবিষ্কারের, উঠে যাওয়া মার্টিন কোম্পানির রেললাইন ডিঙানো নিষিদ্ধ জগত, কাদায় মোড়া সংসারে দারিদ্র্যের দুই ফোঁটা তাজমহল, উজ্জ্বল সম্ভাবনার বিনাশ, অজস্র মৃত্যুর ললাটে কুঞ্চিত ব্যর্থতার কেশদাম। বিষণ্ণতার বিধুর রঙে রাঙানো এই লেখা এক একাকী বয়ে চলা নদীর, যাতে ভেসে যায় লখিন্দর আজও কলার মান্দাসে, মমতাময়ী মা তার উপর মশারি বিছিয়েদিয়েছেন কেবল, টানটান।
সীমা গঙ্গোপাধ্যায়
জন্ম সীমার টাকীতে। চেনার চৌহদ্দির সবাই উদ্বাস্তু, এসেছেন পূর্বপাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশ থেকে। কল্পনাপ্রবণ সীমা ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের কাছে শোনে সাতক্ষীরার সন্দেশ আর নুননগরের দোলের গল্প। আজও অমলিন প্রথম ইছামতী দেখার স্মৃতি। নদী পেরিয়ে ঝিলিক দেয় ওপারের দেশ, পূর্বপাকিস্তান। লেখাপড়া জমিদার অধ্যুষিত বনেদি টাকীর গার্লস স্কুলে। তারপর টাকী গর্ভমেন্ট কলেজের পাঠ চুকিয়ে কলকাতা ইউনিভার্সিটির বাংলায় এমএ। স্বভাবঅলস সীমাকে চাকুরি কখনও টানেনি। বিবাহসূত্রে পাকাপাকিভাবে চলে আসা কলকাতার উপকণ্ঠে। সময়ে আসে সন্তান দীঘির। আবার ব্যস্ততা, উদ্বেগে থাকে সময়।
দু’হাজার চোদ্দোর দশ এপ্রিল দীঘিরের চিরকালীন থেমে যাওয়ার খবর আসে। থেমে থাকেননা সীমা। শুরু হয় নতুন অধ্যায়। তিলেতিলে গড়ে ওঠে শোকগাথা — দীঘির কথা, জন্মদাত্রীর দিনলিপি। লেখার সঙ্গে যোগ হয় কর্মকাণ্ড। জনসেবার লক্ষ্যে গড়ে তোলেন ‘দীঘির গাঙ্গুলী ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট’। নিয়োজিত আছেন, সুন্দরবনের মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবায়। পাশাপাশি টাকিতে তৈরি করছেন চোখের হাসপাতাল। সুন্দরবন এখন তার দ্বিতীয় ঘর।
সমালোচনাগুলি পড়তে ছবির উপর ক্লিক করুন।