নদিয়া, কুষ্টিয়া, বীরভূম, নেত্রকোনা, মুর্শিদাবাদ, যশোর, বাঁকুড়া, সিলেট, বর্ধমান, রাজশাহী, ময়মনসিংহ— দুই বাংলার আনাচকানাচে ফকির বাউল, দরবেশ, বৈষ্ণব, সহজিয়া আখড়াবাড়িতে গুরু- মুর্শেদদের সাধনা, আচার, জীবনপ্রবাহ, খাওয়া- দাওয়া, আশা, প্রেম, মা- গুরুদের স্নেহময়ী অবস্থানটা আদতে কী রকম সেই বৃত্তান্তই ছড়িয়ে রয়েছে গোটা বই জুড়ে লেখকের আঠারো বছর ধরে সুদীর্ঘ আখড়াবাসের অভিজ্ঞতায়। আখড়ায় বাউল ফকির সাঁই দরবেশের সমাগমে স্বাদ সাধনার বিচিত্র আয়োজন। গুরুর কাছে তত্ত্বের পাঠ নেওয়ার পাশাপাশি মা গুরুর নিবিড় স্নেহচ্ছায়ায় তিলতিল করে সেজে ওঠে নিত্যসেবা। গভীর জলের রুই কাতলা মৃগেল না কি সাক্ষাৎ তপস্বী, কুম্ভক-রেচক বিদ্যা তাদের জন্মসুত্রে তাই আসে বড় রুইয়ের ডিম ভাজি, মেটে আলু দিয়ে রুইয়ের কালিয়া, রুইয়ের মাথা দিয়ে রাঁধা লাউমুড়া তেঁতুল দেওয়া মাছের অম্বলের মতো এযাবত অশ্রুত পদের দেখা মেলে আখড়ায় আখড়ায়। কখনও অন্নসেবায় মেলে কচুর লতি দিয়ে পুঁটিমাছ, শুকনো কাঁচকি মাছের ঝুরি আর চুকাই ফলের অম্লতার মিলমিশে তৈরি কুচো চিংড়ির ভর্তা। এ সবের সঙ্গে রয়েছে হরেক ঝলসানো পদের অনবদ্য সমাহার—ধনেপাতার লেইমাখা ঝলসানো ইলিশ, বিশাল ভোলার পেট চিরে চালের গুঁড়ি মরিচ-সরষের লেইয়ে লেবুর রস নিঙড়ানো অনবদ্য স্টাফিং পুরে ঢিমে আঁচে ঝলসানো, গাঁজা পাতা ও কাঁচা মরিচের সঙ্গে বাটা লটে মাছ বা কলাপাতায় মুড়ে ঝলসে নেওয়া তোপসে মাছে আমচুর ছড়িয়ে ও পেটে মশলাপোরা পমফ্রেট ঝলসে তার ওপর আমতেল ঢেলে পরিবেশন অথবা তুলতুলে নরম ঝলসানো হাঁসের মতো দুর্লভ রান্নার হদিশ মেলে সাধক-ফকিরের নিভৃত হেঁশেলেই।
আখড়া আর ফকিরবাড়ির আপাদমস্তক জুড়ে রয়েছে হরেক মরশুমি সুবাস। ছোট মাছ দিয়ে চুকাইপাতার খাট্টা বা আতপ চালে গুড় দেওয়া ক্ষীরের মতো রসনাসুধার নানান উপাখ্যান যা এপার ওপার দুই বাংলার সাধনচিত্রে নকশিকাঁথার ফোঁড় বসিয়ে গিয়েছে নিরন্তর। সুখাদ্যের এই বৈভবের সঙ্গে জুড়েছে নিরাকারের সাধনায় নিবেদিত গীত, ঈশ্বর বন্দনায় কাঁথার ভূমিকা আর অজস্র টীকায় দুই বাংলার সাধকের পরিচিতি, ঘর ঘরানা, সাধন সংকেত নিবেদিত। এই বই দুই বাংলার আখড়াবাড়িতে গুরু- মুর্শেদে দীক্ষা পেয়ে সাধনসঙ্গিনীর সহায়তায় কীভাবে যুগল ভজনা, কায়াবাদী দেহসাধনা এখনও নিশ্চুপে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে, তারই এক পুঙ্খানুপুঙ্খ নবীন আলেখ্য।
সোমব্রত সরকার
প্রাকৃতজনের আচার- কৃষ্টি- সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে চলেছেন। গ্রাম বাংলার বাউল, ফকির, ভৈরবী, সাধু, অঘোরী, সহজিয়াদের সঙ্গে তাঁর বিস্তর ওঠাবসা। গ্রামাঞ্চল ঘুরে সংগ্রহ করেছেন লোকগান ও লোকসাধকদের ভাষা। পশ্চিমবঙ্গের বাউল, ভৈরব ভৈরবীর সঙ্গে তন্ত্র জিজ্ঞেসায়, রাতের শ্মশানে অঘোরী সঙ্গ, দুই বাংলার বাউল আখড়া, দেহতত্ত্বের গোপন কড়চা বইগুলো দুই বাংলার বিদগ্ধ মহলে আলোচিত। কলকাতা- ঢাকা- ত্রিপুরা মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পঁচিশ। ভারত সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রকের ফেলোশিপ পেয়ে গবেষণা করেছেন বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে।
সমালোচনা/ আলোচনা পড়তে ছবির উপর ক্লিক করুন।