এক কারুকার্যমণ্ডিত কাঠের দরজা হাট-করে খোলা। বাইরে পড়ে অপরূপ বৈচিত্রময় নদীনালা খেত-খামার, রহস্যময় জীবনপ্রবাহ। বিস্মৃতির অবগাহনে চলে যাওয়া চরিত্রেরা, অন্ত্যজ-গানে গল্পে বুনে চলেছে এক ভিন্নতর সাংস্কৃতিক বয়ান, হারানো হেঁশেলনামা। পাখি শিকার থেকে মাছ ধরার গল্প। এলোমেলো মেয়ালিপাঠ।মাত্র বছর তিরিশ আগে কেটে যাওয়া সেই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে দেখা সময়ের জানালায়। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। স্বাদগুলি এখনও হারিয়ে যায়নি জিভের চোরাগলিতে। যে খণ্ড খণ্ড জলছবি ফুটে রয়েছে বই জুড়ে তা সিক্ত। কখনও রসনায়, কদাচ কান্নায়। ছবিগুলিতে কোনও নতুনত্ব নেই। মৈমনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকার মতোই তারা স্বভাবে প্রাচীন। এই লেখা আসলে কিছু ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন সময়ে খোঁজ করা অন্দরমহলের পাঁচালি। দেশান্তরী জীবনে নিভৃত অন্তঃপুরে বসে সামরান বুনলেন তার চিত্রল নকশা, খোঁজ করলেন অদৃশ্য এক সংস্কৃতির।হারানো বাংলাদেশের।
সামরান হুদা
জন্ম সিলেটের ঝর্ণার পারে। বড় হওয়া সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের সুরমা নদী আর তার আশেপাশে ছড়ানো পাহাড়ি টিলায়। প্রতিটি ছুটির দিনে ছুটে যাওয়া দেশের বাড়ি। তিতাস পারের ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়। বিনোদনে নৌকা বাইচ অথবা বাড়িতে কর্মরত মেয়েদের কাছে শোনা রূপকথা। পুবালি বাতসে সূয়া ওড়ে অহরহ মেয়েলি গীতে। অতঃপর অন্তঃপুরে প্রবেশ। ১৯৮৬ সালের পাতা ঝরা এক শীতল দিনে ছেড়ে আসা প্রিয় বাংলাদেশকে। ক্রমশ অভ্যস্ত দেশান্তরী জীবনে। হেঁশেলকেই হাতিয়ার করে অন্তঃপুরবাসিনী। বিলাসে বারে বারে ফিরে যাওয়া সেই সবুজ বাংলাদেশে। অগত্যা লেখালিখিই তাঁর সেই সময়যান।
দ্বিতীয় বই অতঃপর অন্তঃপুরের জন্য ২০১৫ সালে পেয়েছেন নমিতা চট্টোপাধ্যায় সাহিত্য পুরস্কার।
বিবিধ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সমালোচনাগুলি পড়তে ছবি বা লিংকে ক্লিক করুন।
পরম্পরার অমল দীর্ঘশ্বাস লিখলেন মিহির সেনগুপ্ত।আগস্ট ২০১৮, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম।
“আমি মানুষটা সেই জাতীয় গোষ্ঠীভুক্ত, যারা শুধু ভালো জিনিস ভালো খায়, এমন নয়, আমাদের ধরনটা হচ্ছে খাওয়াটাকেই ভালো হিসাবে মান্য করা। সাদা কথায় আমাদের পেটুক বলা হয়ে থাকে। বাঙাল গার্হস্থ্যের সুবর্ণযুগে, সেরকম পরিবারে জন্মাইনি বলে, ভোজন-রসিক যাকে বলে, তা হয়ে ওঠার ভাগ্য ছিল না। তথাপি একেবারে যে অরসিক, তা নই। তবে একটা সৎ গুণ, বাঙ্গাল-বিধায় রপ্ত হয়েছে, ‘রন্ধন’ বিষয়ে লেখা, গল্প, ছায়াছবি প্রভৃতি আমার মতো লোকদের যে খিদে বাড়ায় বা ‘কদাচিৎ-অগ্নিমান্দ্য’ দূর করে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ রাখি না। অগ্নিমান্দ্য ব্যাপারটা আমার বিশেষ ঘটে না বলে ‘কদাচিৎ’ বিশেষণটা ব্যবহার করলাম।
এত কথা ঘ্যানাচ্ছি এই কারণে যে লেখক সামরান হুদার ‘অতঃপর অন্তঃপুরে’ নামক গ্রন্থখানি পড়ে, আমার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ঘটেছে নিজের ‘নোলা সমস্যা’। আমার পরমারাধ্যা পত্নীদেবীর এখন বৃদ্ধাবস্থা। তথাপি, আমার ‘নোলা’ তৃপ্ত করার সদিচ্ছায় তাঁর যে আদৌ অনিচ্ছা আছে, এমন মিথ্যে কথাটা বলতে পারব না। মিথ্যে বলব না। তাঁর শেখার আকাঙ্খাও যথেষ্ট আছে। কিন্তু সমস্যা বয়সজনিত কারণে কর্মক্ষমতার অভাব এবং অলপ্পেয়ে ডাক্তারগুলো আমাদের উভয়ের মধুমেহ ব্যাধির কারণে পিঠে-পায়েস এবং বিশেষ বিশেষ সুখাদ্যগুলিতে ঢ্যাঁড়া দিয়ে রেখেছেন বলে সামরান বিবির নির্ধারিত পথে পা বাড়াতে, অর্থাৎ রন্ধন-কাঠি হাতে নিতে পারছেন না।”
সম্পূর্ণ পড়তে ক্লিক করুন এখানে।
প্রথম গাঙচিল সংস্করণের সমালোচনা আনন্দবাজার পত্রিকায়।১২ এপ্রিল ২০১৪
সমালোচক পবিত্র সরকার লিখেছেন “অন্তঃপুরের কথা শুনলেই যাদের জিভে জল এসে যায় তাদের জিভে জল স্বাগতম্। কারণ এ বইটি সব পাঠকের জন্য লেখা নিশ্চয়ই, তবু সাধারণ (হিন্দু) বাঙালি পাঠকের কাছে এক প্রান্তিক, অর্থাৎ মুসলমান অন্তঃপুরের কথা, শুধু মুসলমান অন্তঃপুরের নয়, সেই সুদূর সিলেটের কিছুটা গ্রামীণ মুসলমান অন্তঃপুরের কথা। ‘জিভে জল’ স্বাগতম্ এই জন্যে যে, এ হল ওই বিশেষ প্রতিবেশের মুসলমান অন্তঃপুরের রান্নাবান্না খাওয়াদাওয়ার কথা, যে কথা পড়ে কারও জিভে জল না এলে এই চমৎকার বইটি দুঃখিত ও অপমানিত বোধ করবে। লেখিকা সিলেটের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, বহু দিন কলকাতার বাসিন্দা হয়ে আছেন, কিন্তু সিলেটের গ্রাম ও পিতৃকুলের জীবন ও রসনাবিলাসকে তিনি স্মৃতিতে অতিশয় মমতা নিয়ে বহন করে চলেছেন। এ বইটি সেই স্বাদু স্মৃতিকণ্ডূয়ন, ‘পদ’-এর রন্ধনশালার অর্থ ধরে ‘স্বাদু স্বাদু পদে পদে’ও বলা যায়। তাই এই বইটি খাদ্যপ্রেমী, কিছুটা সংস্কারহীন হিন্দু বাঙালি পাঠকের (সে রকম কিছু এই বাজারেও আছে আশা করি) কাছে রান্নাঘরের আশেপাশে ছোঁক ছোঁক করার এক নতুন আমন্ত্রণ তুলে ধরবে। এই সাধারণ নির্বাচনের মুহূর্তে ‘হিন্দু’ কথাটা বার বার উচ্চারণ করতে ভাল লাগে না, কিন্তু আমাদের পাঠকদের সীমাবদ্ধতাকে, এক বৃহৎ বাঙালি গোষ্ঠী সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতাকে আমরা একটু খোঁচা দেব বলেই কিছুটা জুলুমের মতো করে ওই শব্দটির ব্যবহার। প্রাতরাশ থেকে দিবা ও নৈশভোজন, প্রতিদিনকার খাবার থেকে বিবাহ ইত্যাদি উৎসবের আনুপূর্বিক খাদ্য, তৃপ্তিদায়ক খাদ্যগ্রহণের পর পান সেজে বাড়িয়ে দেওয়ার কথাও লেখিকা ভোলেননি। সেই সঙ্গে কেকের উপর আইসিং-এর মতো আছে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য, ছড়া, মেয়েলি গান থেকে নানা বিচিত্র খাদ্যের পদ্যবিবৃতি, যা সাহিত্য ও জীবনকে গভীর বন্ধনে জড়িয়ে নিয়েছে। আজকাল যাকে ‘সংস্কৃতি পাঠ’ বলে, এ বই যেন তারই এক রমণীয় নমুনা।”
সম্পূর্ণ পড়তে ক্লিক করুন এইখানে।
প্রথম সংস্করণের সমালোচনা ভিন্নচর্চা পত্রিকায়