সেই কবে দূর মহালের কাছারি থেকে আসা হাতিদের গলার ঘণ্টায় বেজে উঠত শরতের ছুটির ঠিকানা। রূপকথার খোঁজে বেরিয়ে পড়া স্বআরোপিত বীরব্রত পালনে। শরৎকালের শালজঙ্গল, ভাঙা আনন্দমঠের অবশেষ, সবুজ গাছালিতে ঢাকা গারো-জয়ন্তিয়া পাহাড়, গ্রীষ্মের বিহার ও ওড়িশার ছুলোয়া শিকার, অসমের ঘাসজঙ্গলে হাতিতে চড়ে শিকার, ভারতের সমস্ত বনবাংলোর বিশদ এমন সব টুকরো টুকরো নকশি মণিমাণিক্যে এই বই সেজে উঠেছে অবিশ্বাস্য আমেজী এক কলমের প্রভায়। অধুনালুপ্ত বৈঠকী রম্যতা যার মূলসুর।
জনসংখ্যার চাপে পিছু হটেছে অরণ্য, বিবিধ প্রজাতির অরণ্যবাসী প্রাণীর সঙ্গে বিরল হয়ে যাচ্ছেন এই সব মানুষ, যারা প্রকৃত প্রস্তাবে অরণ্যবিলাসী। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছেন একশৃঙ্গ গণ্ডারের মতো। যমদুয়ারের দাঁতাল হাতির মতো এই লুপ্তপ্রায় প্রজন্মের জঙ্গলগাথার শেষ উদাসী রাজকুমার। খেলার ছলে ষষ্ঠীচরণ হাতি লোফেন যখন তখন−বাস্তব পক্ষে এই অনায়াস একমাত্র অধীত রয়েছে ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরীর। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ হস্তিবিদ ১৯৭২ থেকে বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের মূল হোতা, তাই এই গ্রন্থে সবার উপরে ধ্বনিত হল বন বাঁচাবার আর্তি।
ক্রমে ক্রমে আখ্যান ঘন হয়ে ওঠে রসনাবিলাসের। ময়মনসিংহ স্বাদবাহার গীত হয়। মুক্তাগাছা ও কালীপুরের বাড়িতে যা যা খাওয়া হত তা সত্যিই বিস্ময়কর। আলাপিত হয় কংসের রুই, যমুনার কাতল, পোড়াবাড়ির চমচম, মহাখাসা দই আর মুক্তকেশী বেগুন। এই বইতেই আছে দেশবিদেশের তাবড় খানার হদিশ, আছে গাব খাওয়া বাদুড়ের মাংস, আনারসী খরগোশ বা হাতি রান্নার কেতা দুরস্ত উপাখ্যান।
এই বই তাই সমবেত ঐতিহ্য আর আমাদের পিতৃপুরুষের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির পিলসুজ। যা ক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দু’মিনিটের দুনিয়ায়। তাই হে পাঠক, সাবধানে ধরবেন এই ‘জঙ্গলগাথা ও রসনাবিলাস’। হাতে রস লাগলে কর্তৃপক্ষকে দায়ী করবেন না।
ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী
জন্ম ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ময়মনসিংহ জেলার কালীপুরের অভিজাত পরিবারে। পূর্ববঙ্গে শৈশব, দেশভাগের পরে কলকাতায় স্থায়ী বসবাস শুরু। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সাম্মানিক ইংরেজিতে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ, লিডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি। কেমব্রিজের ক্লেয়ার হল কলেজের আজীবন সদস্য। কর্মজীবনে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা। শৈশব থেকেই জঙ্গলের প্রতি তীব্র আকর্ষণ। ১৯৭৭ সাল থেকে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (IUCN)-এর হস্তি বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠীর এবং ১৯৭৮ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বণ্যপ্রাণী উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। ভারত সরকারের হস্তি প্রকল্প চালু হওয়ার আগে তার রূপরেখা নির্ধারণের জন্য নিযুক্ত টাস্ক ফোর্সের সদস্য ছিলেন। প্রকল্প চালুর পরে তার স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য এবং পূর্ব ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের কো-অর্ডিনেটর। ধৃতিকান্তের অসংখ্য প্রবন্ধ ইতিমধ্যে বহু আন্তর্জাতিক পত্রিকা ও সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সমাদৃত গজ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবেও কাজ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে রয়েছে হাতি ও বনজঙ্গলের কথা, হাতির বই, বৈঠকী, জীবনের ইন্দ্রধনু, A Trunk Full of Tales, The Great Indian Elephant Book ইত্যাদি। ২০০৭ সালে হাতির বই-এর জন্য আনন্দ পুরস্কার। হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতিও তিনি বিশেষ অনুরক্ত।
সমালোচনা আলোচনাগুলি পড়তে ছবির উপরে ক্লিক করুন।