জীবন-মৃত্যু
প্রথম খণ্ড
এ আশ্চর্য মায়ামুকুর, যাতে ধরা আছে স্বাধীনতাপূর্ব অখণ্ড বাংলা থেকে কম্যুনিস্ট শাসনের পশ্চিমবাংলার চালচিত্র। এর শুরু একটি বালিকার শিশুকাল থেকে, এবং এই খণ্ডে ধরা আছে তাঁর যৌবনকালটুকু, আশা, স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতি। দেশ-কাল-সময়-সমাজ-সংস্কৃতিকে বিশ্লেষণ ও যুক্তির ধারালো স্ক্যালপেলে ফালি ফালি করে কেটে ছানবিন করেছেন অসীম রায়। বাদ দেননি নিজেকেও, অহং ও ষড়রিপুর রঙিন আবরণ সরিয়ে নিজেকে খড়মাটিতে দেখতে চাইবার এক অসম্ভব উপাখ্যান এই বই। আত্মউন্মোচনের হাওয়ামোরগ।
বিষ্ণু দে থেকে সমরেশ বসু, প্রকাশ কর্মকার থেকে যামিনী রায়, ইন্দিরা গান্ধী থেকে জ্যোতি বসু, টমাস মান থেকে পাবলো নেরুদা এই দুস্তর পথে অনায়াস চলাচলের এই কাহিনি আসলে এক প্রেমের গল্প। এ গল্প এক তরুণ আর তাঁর অসমবয়েসী বন্ধুর মায়ের দুস্তর প্রেম এক। এ গল্প প্রেমিকার হাতে সুড়সুড়ি দেওয়া ঘাসের ডগাটির। এ গল্প গীতার, এ গল্প অসীমেরও। এ গল্প মেঘলা দুপুরে ছাদে উড়ে আসা ময়ূরের গলার যাদুকরী নীল, যা মোহাঞ্জন পরিয়ে রাখে তরুণী মা আর শিশুটিকে। এক তরুণ ঘোড়সওয়ারের ঝড়ো অভিযানের, জনঅরণ্যে কেবলই খুঁজে ফেরে তাঁর নিজস্ব গল্প, বুনে তুলতে চায় তাঁর একান্ত শব্দের খাঁচা এক। এ গল্প তাই আমাদেরও। আত্মবীক্ষণের যন্ত্র এক। মিলিয়ে দেখতে হয় রক্তের অন্তর্লীন অসুখ ব্যক্তিগত।
দ্বিতীয় খণ্ড
যে জেগে ঘুমোয়, তার ঘুম সহজে ভাঙে না। রিখিয়ার এলোমেলো ল্যান্ডস্কেপে প্রবাসী বাঙালির ইতিহাসের মতো ইতিউতি ওড়ে সুখের ছুটির দিন, মুরগির মাংসের সুবাস। সঙ্গে চলতে থাকে ভারতবর্ষে বামপন্থার ব্যর্থতার কড়াকিয়া-গণ্ডাকিয়া। কলকাতায় বারাসাতে বরানগরে হাজার হাজার মেধাবী ছাত্ররা খুন হয় রাষ্ট্রশক্তির হাতে। আবছা হয়ে আসে বিপ্লবের ট্রামের শিষ। লাল পতাকা ওড়ানোর ঝড়োদিনগুলি আরও লাল হয়ে ওঠে পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্বে, ভ্রাতৃহত্যায়। সংগৃহীত খবরের ভারে বিধ্বস্ত হন কথাকোবিদ। তিনি ক্রান্তদর্শী, তাই জানেন জেগে ঘুমোচ্ছে যে জনপদ, তার ঘুম সহজে ভাঙবে না।
তবুও বদল আসে জীবনযাত্রায়। করুণাধারায় ধেয়ে আসে আরও একটি ভ্রমর, বিস্তৃত বসন্ত ও পুঞ্জীভূত প্রেম। আঘাটায়, মালখালাসী লরির ভিড়ে তাকেও ডেকে ওঠা ‘গীতা’ বলে। এ আবর্তে আশির শুরুতে কেবল তাঁর চারপাশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয়জনেরা। পোষা কুকুর অনি, তাঁর মাস্টারমশাই, সুহৃদ বিষ্ণু দে, দীপেন বন্দোপাধ্যায়, অকৃত্রিম এক পাঠক রানা ঘোষ। গালিবের পত্রাবলীর মতো তাঁর লেখালিখিতেও ক্রমশ নায়ক হয়ে দাঁড়াচ্ছে মৃত্যু, হ্যাঁ এবং মৃত্যুই। এই মহাকাহিনির শেষ তাঁর স্ত্রী গীতার মৃত্যুতে, যা প্রকারান্তরে তাঁর আত্মারই মৃত্যু।
ট্রাজেডি জানতে সফোক্লিস না পড়লেও চলে। জীবনের কোনাকানাচে প্রতিনিয়ত যে ট্রাজেডির অভিনয় হয়ে চলেছে “বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে” বলে তাকে চোখ ঠারা কঠিন। ‘একালের কথা’ থেকে যে ঔপন্যাসিকের যাত্রা শুরু, তিনি বারবার তাঁর নিজেরই জীবন সেঁচে লিখেছেন ‘রক্তের হাওয়া’ বা ‘গোপালদেব’। এ যাবৎ অপ্রকাশিত তাঁর শেষ এই গ্রন্থ আসলে এক সোয়ান সং, মরণোন্মুখ রাজহাঁসের শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত। বামপন্থী, রবীন্দ্রানুরাগী, টমাস মানের মুগ্ধ পাঠক, বাংলা সিরিয়াস সাহিত্যধারার মহারথী অসীম রায় তাঁর এই বই শেষ করছেন “গীতা রায় জিন্দাবাদ” বলে, প্রকারান্তরে যা জীবনেরই জয়গান। এই বই আসলে বাঙালির বৌদ্ধিক চর্চার ইতিহাস। ষাটের দশক, সত্তরের দশক ও আশির দশকের জটিল মননের রাজনীতি। এই বই ভাবতে শেখার পাঠশালা, পায়ে হেঁটে পৃথিবী দেখার কেডসজুতো।
প্রগাঢ় মমতায় এই মহাগ্রন্থ দুটি খণ্ডে সম্পাদনা করেছেন, সাজিয়েছেন একালের অবিসংবাদী কথাশিল্পী রবিশংকর বল। সঙ্গী অসীমপুত্র কুশল। বার বার ফিরে আসার এক সাড়ে তিনহাত ভূমি এই মহাগ্রন্থ, এ কেবল এক আশ্চর্য শুরুয়াৎ।
অসীম রায়
জন্ম ৯ই মার্চ, ১৯২৭, বরিশালের ভোলায়। বাবা ভবেশ চন্দ্র রায়, মা জ্যোৎস্না দেবী। ১৯৪৬ এ প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ স্নাতক। ১৯৪৮এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ স্বর্ণপদক সহ। কর্মজীবনে সাংবাদিকতাই মুখ্য এবং স্টেটসম্যান কাগজে। সহধর্মিনী গীতা বসু। প্রথম বইয়ের নাম নবমল্লিকা। কবিতার বই, প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ এ।
উপন্যাস হিসেবে উল্লেখযোগ্য—একালের কথা, গোপাল দেব, দ্বিতীয় জন্ম, রক্তের হাওয়া, দেশদ্রোহী, শব্দের খাঁচায়, অসংলগ্ন কাব্য, গৃহযুদ্ধ, অর্জুন সেনের জিজ্ঞাসা, একদা ঈষিতা, পলাশী কতদূর, নবাববাঁদী, আবহমানকাল।
এছাড়াও লিখেছেন কবিতা, ছোটগল্প, নাটক, জার্নাল ও আরও অনেক উপন্যাস। স্ত্রীর মৃত্যুতে ভগ্নহৃদয়, নিভৃত ও আত্মমগ্ন অসীম রায় মারা যান ১৯৮৬র ৩ এপ্রিলে।
ছাপাখানার গলি, প্রথম খণ্ড, মে ২০২২ ছাপাখানার গলি, প্রথম খণ্ড, মে ২০২২ ছাপাখানার গলি, প্রথম খণ্ড, মে ২০২২ ছাপাখানার গলি, প্রথম খণ্ড, মে ২০২২ ছাপাখানার গলি, প্রথম খণ্ড, মে ২০২২ ছাপাখানার গলি, প্রথম খণ্ড, মে ২০২২ ছাপাখানার গলি, প্রথম খণ্ড, মে ২০২২ ছাপাখানার গলি, প্রথম খণ্ড, মে ২০২২
একটি সমান্তরালতা : অসীম রায়ের জীবন-মৃত্যু
আবহমান ওয়েবজিনের নববর্ষ সংখ্যা ১৪২৬, সমালোচনাটি লিখেছেন প্রীতম বসাক
“যতদিন সে বেঁচে থাকবে একটাই অব্যক্ত স্লোগান মন্দ্রিত হবে তার হৃদয়ের অন্তস্তলে: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নয়,কোনো রাজনৈতিক নেতা নয়,বোসপাড়া লেনের গীতা বোস জীন্দাবাদ “ – না মশাই গীতা বোস বনলতা সেন নন ।নীরা বা নীরদ সি চৌধুরীর তুতো কেউই নন। তিনি গীতা বোস।আমাদের আলোচ্য গ্রন্থের লেখক অসীম রায়ের সহধর্মিনী। হ্যাঁ এই সুদৃশ্যমান দুইখণ্ডে বিভাজিত নিজকথার সিংহভাগ জুড়ে আছেন এই গীতা বোস। শুধু আছেন বললে ভুল হবে এই গ্রন্থোৎপত্তির কারণও তিনিই –“১৯৮২-র জানুয়ারি মধুপুর,সাঁওতাল পরগনায় যখন বেড়াতে গিয়েছিলাম তখন হঠাৎ হার্টফেল করে আমার পঁচিশ বছরের সঙ্গিনী গীতার মৃত্যু হয়। “ নানা জায়গায় মানে অনেকেই যেমন খোঁজেন রবীন্দ্রনাথ, কার্ল মার্কস, গীতা, ‘মরণের পারে’, ইয়োরোপীয় এবং আমেরিকান প্যারা সাইকোলজি – কোথাও আশ্রয় পেলেন না তিনি। তখনই আত্মানুসন্ধানের পথ খুঁজতে এই আত্মজীবনীর শুরু। তাই “ গীতার বাল্যকাল দিয়ে এই সাধারণ লেখকের আত্মজীবনী শুরু;গীতার মৃত্যুতে এই আত্মজীবনী শেষ।“ আহা আপনারা যারা ভাবছেন এই বিম্বিত বসন্তে আবার দাম্পত্য ঘাটতে হবে তাদের বলি গীতা বোস না হলে অসীম রায় হয় না। তাছাড়া ব্যক্তিগত জীবন ছাড়াও যে তিনটি দশক ধরে লেখক অসীম রায়ের যৌবন কেটেছে সেই পঞ্চাশ ষাট সত্তর দশকের চেহারাও এই জীবনী গ্রন্থের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য।
জনৈক অসীম রায়ের খোঁজে
কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে আমার এই অসীম যাত্রা। কেননা পাঠক এবং আমিও অসীম রায় নামক লেখকটিকে চিনি না। কি, কি এমন লিখেছেন তিনি যে এমন ঢাউস মার্কা ১২০০টাকা মূল্যের দু দুটো থান ইঁট পড়ার শ্রম মেনে নেবো আমরা। এর উত্তর আপনি গুগলে পাবেন না। মস্টার মশাইদের নোটবুকেও পাবেন না। কেননা অসীম রায় রবিবাসরীয় পথভোলা পাঠকের জন্য লেখেন নি। তিনি প্রধাণত ঔপন্যাসিক। এবং ছোটগল্পকার। তাঁর অন্তত দুটো কবিতা এমন আছে যাদের একটি ৩০০ লাইনের অন্যটি ১০০। সেখানও আপনি পাবেন উপন্যাসেরই বিস্তার। বেশ। তা না হয় কবিতা আপনি নাই বা পড়লেন! কিন্তু হে চিন্তক পাঠক তাঁর উপন্যাস আপনাকে পড়তেই হবে যদি আপনি পড়তে চান। কেননা তিনি সেই বিরল ঔপন্যাসিকদের অন্যতম যিনি বুঝতেন – “ সময়ের সংগে নিজেকে মিলিয়ে নেওয়ার জন্য যে পাঠক হাত বাড়াবেন তাঁর প্রয়োজন তো শুধুমাত্র চলতি ধারার গল্প উপন্যাসে মিটবে না।তার জন্য গল্পকে গল্প ছাড়াও আরও- অনেক-কিছু বলতে হবে।আর এই আরও-অনেক-কিছুর মধ্য দিয়েই লেখকের চরিত্র ধরা পড়ে।একটা দেশ বা সমাজের যে-সব তথ্য পরিসংখ্যানের বইয়ে সহজে মেলে,খবরের কাগজে ছাপা হয়ে বেরোয় গল্পের ঐ আরো-অনেক-কিছুর মধ্যে তার চেয়েও স্পষ্ট কিছু সত্য ধরা থাকে,ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়। লেখকের প্রচেষ্টার ঐ বিশ্বস্ততার জন্যই একটি লেখা একই সংগে হয় কাহিনী, ইতিহাস,ইস্তেহার ও ব্যক্তিগত ডায়েরি। লেখার ধারণক্ষমতাকে সেই পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব যতদূর পর্যন্ত মানুষের চিন্তা ও কল্পনা যেয়ে ওঠে। এবং স্বাভাবিকভাবে, অনভ্যস্ত পাঠকের চোখে তা জটিল ও জড়ুলসর্বস্ব মনে হতেও পারে। গল্প বা উপন্যাস তো একটা শিল্পরূপমাত্র নয়,ব্যক্তিত্বের প্রকাশ মাধ্যমও। অন্যদিকে লেখক শুধুমাত্র একজন সমাজতাত্ত্বিক বা নিছক রাজনীতিবিদ নন। লেখকের স্বাধীন বিবেকের বশ্যতা একমাত্র সত্যের প্রতিই কেবল। আর সেই অর্থে একজন লেখকের কাজই হল সমস্তরকম প্রশ্ন উথ্থাপন করা,সবদিকের এবং বিকল্প বাস্তবতা, তার সম্ভাবনা সর্বদা বিচার করে দেখা। আমাদের ওপর আরোপিত পছন্দের বাইরে আমরা যেন নিজেদের পছন্দও চিনে নিতে পারে।“
১৯২৭ সালের ৯ মার্চ অসীম রায় জন্মগ্রহণ করেন ভোলায়। বাবা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ায় কর্মসূত্রে তাঁদেরকে বাংলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করতে হয়েছিল। ম্যাট্রিক পাসের পর ভর্তি হন প্রেসিডেন্সী কলেজে। ১৯৪৬ সালে সেখান থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ স্নাতক হন। ১৯৪৮-এ এমএ পাস করেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৫০ সালে চাকরি নেন স্টেটসম্যান পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে। এর পরে বিভিন্ন কারণে বারবার বেকারও থেকেছেন কিছুদিন। মোট পঁয়ত্রিশ বছরের সাংবাদিকজীবন তাঁর সাহিত্যে প্রতিফলিত। ছাত্রাবস্থা থেকেই অসীম রায় ছিলেন বাম রাজনীতির সংস্পর্শে। রাজনৈতিক ও নীতিবোধ পরিকবর্তন, পরিবর্ধন এলেও তিনি একেবারে সরে যান নি। সমাজতান্ত্রিক অদর্শের বিশ্ববীক্ষা থেকে। তাঁর সাহিত্যকর্মে বৈপ্লবিক এ-চেতনটি উপস্থিত। ব্যক্তি জীবনে অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথেই হয়েছিল মতের অমিল। কখনও সে অমিল দ্বন্দ্বেও রূপ নিয়েছে বৈকি। তাঁর ব্যক্তিজীবনের এ সকল প্রেম অ-প্রেম সমস্ত কিছুই তাঁর সাহিত্যে বর্তমান – কখনও কখনও সরাসরিভাবেই। ব্যক্তি অসীম রায়, ব্যক্তি অসীম রায়ের সাথে তাঁর সাহিত্যিক মনের সংযোগ সাধন ইত্যাদি নিয়ে স্পষ্ট ধারণার জন্য তাঁর দীর্ঘ জার্নাল (ডায়েরি) পাঠককে অনেক সাহায্য করে।
১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় অসীম রায়ের প্রথম উপন্যাস একালের কথা। ভারতের স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্তে ১৯৪৬ সালে কোলকাতায় সংঘটিত হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়িক দাঙ্গা এ উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য। সে সঙ্গে এতে রয়েছে সে সময়কালের সামাজিক ইতিহাসের একটি অধ্যায় যেটি তাঁর পরবর্তী উপন্যাস গোপালদেব (১৯৫৫) এবং দ্বিতীয় জন্ম(১৯৫৭) উভয়েতেই বর্তমান। এরপর একে একে অসীম রচনা করেন রক্তের হাওয়া (১৯৫৯), দেশদ্রোহী (১৯৬৬), শব্দের খাঁচায় (১৯৬৮), অসংলগ্ন কাব্য (১৯৭৩), একদা ট্রেনে (১৯৭৬), আবহমানকাল (১৯৭৮)। ইতোমধ্যে গল্পকবিতায় 9নকশালবাড়ি আন্দোলনের পটভূমিকায় উপন্যাস গৃহযুদ্ধ এবং ১৯৭৫-এ কৃত্তিবাস-এর শারদীয় সংখ্যায় অর্জুন সেনের জিজ্ঞাসা প্রকাশিত হয়। সমকালীন সময় এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে আবহমানকাল-এর মহাকাব্যিক রচনা শেষে অসীম দৃষ্টি ফেরান ইতিহাসের কালগর্ভে। ১৯৭৯ ও ১৯৮০-তে তার তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায় সেগুলো গ্রন্থরূপ পায় নি। সে তিনটি উপন্যাস হলো পলাশী কতদূর (শারদীয় পরিবর্তন), নবাব ক্লাইভ (শারদীয় পরিচয়) ও নবাব আলিবর্দী (শারদীয় বসুমতী)। বারোমাস পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত উপন্যাস নবাববাদী ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থরূপ লাভ করে। ১৯৮২-তে প্রকাশিত তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস হলো কচ ও দেবযানী। একই সঙ্গে ৬৩টি গল্প লিখেছিলেন তিনি। অমর মিত্র বলেছেন “অসীম রায় সারজীবনে ৬৩টি গল্প লিখেছেন।প্রতিটি গল্পই মণিমুক্তো।“ এবার সত্য করে বলুন তো হে পাঠক এই লেখকের কতটুকু আমরা জানি!
বই-বস্তু
রাজনীতিকে এভাবে এর আগে কেউ ব্যাখ্যা করেছেন কিনা জানিনা ,তবে, এএক অনবদ্য ডিসকোর্স। “রাজনীতির দুটো দিক, তার কবিতার দিক আর গদ্যের দিক।“ ‘রাজনীতির ট্যাকটিকাল চেহারা অর্থাৎ গদ্যের দিক’ যেখানে ‘মেনে নেওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর থাকে না।শমঙ্খলার কথা ভেবেও জোর করে বলা যায় না’। পাঠক এবার একটু ভেবে নিন আমরা ঠকলাম না তো! এই রাজনীতির ঠেলায় পরেই তো আমরা পেলাম আধখানা মানিক আধখানা সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। আর রাজনীতির কবিতার দিক তো প্রতিটি ভাবুককে আকৃষ্ট করেই। ‘ভারতবর্ষেরর মতো দরিদ্র নন অনগ্রসর পরস্পর বিবদমান মানুষগুলোর দেশে এক পরম কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়’। “ফাঁসির আগে জেল থেকে লেখা দীনেশের চিঠি এই স্বপ্নকে ভাষা দেয়,কিন্তু ভারতবর্ষের Freedom at midnight একেবারে ঠাণ্ডা মাথায় হিসেব-কিভাবে ইংরেজদের সাথে আপোষ করে রাষ্ট্রযন্ত্র কব্জা করা যায়…।”
স্বপ্নই একদিন লেখককে নিয়ে গিয়েছিল প্রত্যক্ষ রাজনীতির রাস্তায়। আ.এ.এস পরীক্ষা না দিয়ে নাম লেখালেন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিতে। ‘রশিদ আলি দিবস’ থেকে ভিয়েতনাম দিবসে উত্তাল কলকাতায় পুলিশের সঙ্গে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করলেন। কেমন ছিল সদ্য যুবকের সে সময়ের ভাবনা – “ পৃথিবীতে অনেক কিছু ঘটছে ঘটবে। আমাদের দেশেও ঘটবে। সেজন্য সামিল হয়ে যাও। আর একটা ধাক্কা – ব্যস সমস্ত দরজা খুলে যাবে। কোন বাধাই আর বাধা থাকবে না।“ ফরাসি রেজিসটেন্স মুভমেন্টের নেতা গাব্রিয়েল পেরির “Communism is the youth of the world which prepaers our morrows to sing” এই কথাগুলো লেখকের কানে গম গম করে বাজত। সবকিছু ওলোটপালোট করার এই সময়ে ঘরে থাকা যায় নাকি! তাই মাঝে মাঝে গ্রামে যাওয়া।মিছিলে হাঁটা। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ।‘ জেলের তালা ভাঙতে হবে’ স্লোগান।
আবার হঠাৎ করেই এই ধ্বংসাত্মক রাজনীতির আনরিয়ালিটির সঙ্গে সাক্ষাৎ। এবং উপলব্ধি “ প্রত্যেক মানুষকে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় তার পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে হয়,নইলে চার পাশের জীবনের চেহারা কখনও প্রত্যক্ষতা ও সজীবতা লাভ করে না।“ সুতরাং উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলের প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে রিটায়ার হার্ট। তাই বলে ভাববেন না অসীম রায় রাজনৈতিক চেতনা থেকে দূরে সরে গেলেন। বরং উল্টো। এবার তিনি আরও গভীর ভাবেই তাঁর লেখায় রাজনীতিকে ব্যবহার করলেন। এমনকি আশির দশজেই যে ভাবে বামফ্রন্ট সরকারের সমালোচনা তিনি করেছেন তা তার গভীর জীবন দর্শনের উজ্জ্বল দিক। বামপন্থার একবগ্গা রূপ নয় তিনি বরং তার প্রয়োগের মানবিক দিক নিয়েই ভাবিত ছিলেন।
দেশভাগ, হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা, সত্তর দশক তাঁর আত্মজীবনীর অনেকাংশ জুড়েই থাকে। আর প্রত্যেক ক্ষেত্রেই লেখক ক্রিটিকাল। অসম্ভব নিরপেক্ষ দেখার ভঙ্গী তাঁর। আর তাঁর লেখায় এত রাজনৈতিক অনুষঙ্গ কেন চলে আসে সে প্রসঙ্গে তিনি লেখেন –“ তার বিশ্বাস সময়ের ছবি স্পষ্ট নির্মোহভাবে তুলে ধরতে বিশেষ করে সিরিয়াস গদ্য লেখক যে চেষ্টা করে চলেছেন সারা দুনিয়ায় সেই ধারা অক্ষুণ্ণ রাখতে বঙ্গদেশীয় লেখকরাও সচেষ্ট হবেন। “’আজকের ড্রয়িংরুম সাহিত্য কপচানো লেখকেরা শুনছেন কি। তাকিয়ে দেখুন বিশ্বের তাবড় লেখককুলের দিকে। রাজনীতির কি অভিজ্ঞান তাঁদের লেখাকে বিশ্বের দরবাদে জায়গা করে দিয়েছে। মার্কেজ, কুন্দেরা,কাফকা কে নেই তাতে। ঘরেই দেখুন না ‘গোরা’,’ঘরে-বাইরে’, ‘চারঅধ্যায়’। এমন ক্রিটিক্যাল হতে আপনাদের সাহসে কুলোয় না বলুন!
জনপ্রিয় লেখক তিনি সেদিও ছিলেন না। তার সুবিধাও ছিল নিশ্চয়। বহু অন্যধারার লেখকের সাথে সখ্য গড়ে উঠেছিল অসীম রায়ের। তারাই তার লেখার অনুরাগী হয়ে তাকে অক্সিজেন জুগিয়েছেন। যেমন কৃষ্ণগোপাল মল্লিক। ষোল বছর স্টেসসম্যানে সাব এডিটরের দায়িত্ব সামলে হঠাৎ একদিন চাকুরি ছেড়ে দেন বাংলা ম্যাগাজিন ও প্রকাশনা চালাবেন বলে। এই কৃষ্ণগোপাল অমীম রায়কে ‘পথে নামানোর’ দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সত্যিই নামিয়েছিলেন তিনি। প্রথম গল্পের বই করে। পেপারব্যাক। যা অসীম রায়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় বই। আবার অসীম রায়ের কবিতা সংগ্রহ ‘আমি হাঁটছি’ও কৃষ্ণগোপালের কেরামতি। আর একজন নিহাররঞ্জন রায়।“আপনি যে এত ভালো বাংলা লেখেন আগে তা জানতাম না”’ শব্দের খাঁচায়’ পড়ে তাঁর মন্তব্য। আমার বিশ্বাস ভাগ্যি অসীম রায় ইংরেজি পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন। তাই বাংলা সংবাদপত্রের লেখকদের ভূত তার ঘারে চাপে নি। আর তার ভাষা হয়ে উঠেছে ‘জবরদস্ত ভাষা’।
আবার প্রাবন্ধিক অমলেন্দু বসুও অসীম রায়কে ঠিকই চিনেছিলেন। “অসীম রায়ের উপন্যাস পড়ে আমার ধারণা হয়েছে তিনি ঘটনার রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার অভিসারী নন,তিনি ছককাটা প্লটের সংযোজনায় মুগ্ধ নন,তাঁর নিয়ত লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তিসত্তার উন্মোচন” -অমলেন্দু বসুর এই কথাগুলি একইভাবে প্রাসঙ্গিক ‘জীবন-মৃত্যু’র ক্ষত্রেও।এর প্রতিটি শব্দ লেখকের ব্যক্তিসত্তার উন্মোচন। এবং আর একজন অবশ্যই দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই বামপন্থী লেখক কিন্তু অসীম রায়কে অত্যন্ত কদর করতেন।এবং বিষ্ণু দে। তাঁর পুরো অস্তিত্ব নিয়ে এই গ্রন্থে উপস্থিত। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা খরচ হয়েছে লেখকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের নানা দিক। এই আত্মজীবনীর একটি চরিত্রই যেন তিনি। একজন সিরিয়াস লেখককে যেভাবে আজীবন সঙ্গ দিয়েছেন তিনি,ভরসা করেছেন- তাতে বিষ্ণুদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বাড়িয়েছে। তবে ভাববেন না লেখক শুধু বিষ্ণু দে সম্পর্কে কম ক্রিটিক্যাল ! দীপেন্দ্রনাথ এই কারণেই না বলেছিলেন, “ আপনি তো কাউকেই ছাড়েন না।“
এ গ্রন্থের একটি অতি গুরুত্ববহ অংশ অসীম রায়ের জার্নাল। জার্নাল লেখার রেওয়াজ এদেশীয় লেখকদের খুব একটা নেই।কিন্তু যখন ক্রিয়েটিভ রাইটিং আসছে না তখন জার্নাল লেখা একটা নিষ্ক্রমণ বলে মনে হয় আমার। নিজের সঙ্গে দেখা করাটাও প্রয়োজন বৈকি! বিভিন্ন ঘটনা ব্যক্তিগত এবং বহিরাগতভাবে কিভাবে গ্রহণ করে একজন লেখকের মন তা দেখিয়ে দেয় জার্নাল। যদিও সেক্ষেত্রে লেখকের সৎ থাকাটা একান্তই প্রথমিক শর্ত। এবার অসীম রায়ের মনের সিসমোগ্রাফে নানা ঘটনার রেখাপাত একটু দেখা যেতে পারে ।কমলকুমার মজুদারের ‘অন্তর্জলিযাত্রা ‘ পড়ে লেখকের প্রতিক্রিয়া : একটা আশ্চর্য লেখা পড়া গেল। কমলকুমার মজুমদারের অন্তর্জলী যাত্রা। ভাষার পরীক্ষার দিক থেকে লেখাটা আশ্চর্য -চিত্রকরেরর তুলি দিয়ে লেখক লিখেছেন।বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যও অপরিসীম।…… সাম্প্রতিক কালের চমক সৃষ্টকারী ভঙ্গি অথবা ভাষা ব্যবহারের চটুলতা থেকে মুক্ত এ ভাষা”। সমকালের এক ভিন্নধারার লেখকের প্রতি আর এক সিরিয়াস লেখকের এই মূল্যায়ন ভালোলাগে । আরও ভালোলাগে ক্রুশ্চেভ ও নেহেরুর কলকাতা আগমন উপলক্ষে তিনি যখন এই কথাগুলো লেখেন – “মনুষ্য সভ্যতার ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে এ ভাবনা হয়তো নিরর্থক নয়। নেহেরু ক্রুশ্চেভদের মত ভগবানের দূতের জন্মগ্রহণ ঐতিহাসিক কারণেই অবাঞ্ছনীয়।সভ্যতার মূলকথা মানবের অগ্রগতি, মহামানবের দিগ্বিজয় নয়। গান্ধিজি, নেহেরু না থাকলেও ভারতবর্ষ স্বাধীন হত : সাধারণ মানুষের জীবনের কাঠামো খুব আলাদা হত না।যেন একজন সমাজবিজ্ঞানীর কণ্ঠস্বর কানে বাজে।
আর এই জার্নালেই পাই সেই হিসেব যা আমাদের পাঠক হিসেবে লজ্জা দেয়। এখানে লেখক ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত ‘একালের কথা’ থেকে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ‘অসংলগ্ন কাব্য’ পর্যন্ত কুড়ি বছরে তাঁর বিক্রি বাবদ পাপ্ত রয়ালটির হিসেব দিয়েছেন :
একালের কথা ৫০০
গোপালদেব (-)৫০০
দ্বিতীয় জন্ম। ০০
রক্তের হাওয়া ২৫০
দেশদ্রোহী ২৫০
শব্দের খাঁচায় ৭০০
অসীম রায়ের গল্প। ৩০০
অসংলগ্ন কাব্য। ৮০০
লেখক মোট পেয়েছেন : ২৩০০
লেখক যোগ করেছেন –“এই অঙ্কটা এখন ঠিক আমার স্টেসসম্যান অফিসের মাসিক মাইনে।….তারমানে কুড়ি বছরব্যাপী সাহিত্যিক পরিশ্রম এক মাসে স্টেটসম্যানে সাংবাদিক পরিশ্রম।“ যদিও তিনি পরে কিছুটা আশাবাদী হয়ে বলেছেন “ ….এটা আমার বিশ্বাস( বোধহয় ভ্যানিটি নয়), আমি যখন থাকবো না তখন আমার বই লোকে পড়বে। “ না মিস্টার অসীম রায়, এখনও সেই শুভলক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না, এখনও আপনার মত লেখকেরা এ বঙ্গে কল্কে পায় না। আমাদের রাজনীতি- অর্থনীতি -সমাজনীতির ব্যর্থতা আমাদের মণ্ডূক করে রেখেছে। বৃহৎ লাফের দম আর আমাদের ফুসফুসের পক্ষে সম্ভব নয় বলেই বিশ্বাস।