স্মৃতি এক নিঃশব্দ আততায়ী। সে চোখ খুলে দেখেছে ফোকলা মফস্বল, টানা বারান্দা, পটুয়ার আঁকা চোখ। পরবর্তীতে আবিষ্কার আর্ট কলেজে ফুলের পাপড়ি মেলা দেখতে থাকা বিভোর গোপাল ঘোষকে। শিল্প নামক নিষিদ্ধ জগতে অনুপ্রবেশ তাকে চিরপথিক করে তুলেছে। নিভৃত পরিচর্যায় সে ছায়া অনুসরণকারী, জেনেছে এই সমাজ, চোরাগলি ও ক্ষত। পাশে হাঁটতে থাকা মানুষগুলি ঝরেছে তারার মতো টুপটাপ।
ধরাবাঁধা শিল্পকর্মে আটকে না থেকে ক্রমশ বিস্ময়ের সীমা অতিক্রম করে গেছেন তিনি। খুঁজে বেড়িয়েছেন বাউল ফকিরদের পদচিহ্ন, নাটকের মহলাকক্ষে এঁকেছেন অভিনেতার চরিত্রে প্রবেশের সন্ধিক্ষণ, অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে এঁকেছেন ঋত্বিক কুমার ঘটকের বর্ণমালা। কখনও আড্ডায়, কখনও নেশায়, কখনও আখড়ায়, কখনও তৃষ্ণায় তার তুলি কখনও শুকায়নি। কলমও নয়। সময়ের সংঘাতকে ধরার, মানুষকে চেনার বিচিত্র পদ্ধতি জমতে জমতেই তৈরি হয় ‘ঝরা সময়ের কথকতা’। সময়ের অখণ্ড ধারাবিবরণী আঁকা হয়েছে রামকিংকর বিনোদবিহারী থেকে হালের দেবশংকর হালদার পর্যন্ত।
এই বই না-ছোড় শিল্পীর সাবালক জিজ্ঞাসা, নিষিদ্ধ প্রেমের সার সার ক্ষততে উদ্বেল আমাদের বুদ্ধিজীবীদের নোটবুক, অকাতর ঝগড়া-মারামারির তন্নিষ্ঠ বিবরণ, পিএনপিসিপিপাসুদের মৃত সঞ্জীবনী। এতে ধরা রইল অগ্রদীপের মেলায় চোরেদের কার্যক্রম, বোলপুর স্টেশনের মশাদের হুঙ্কার, দীপক মজুমদারের ছৌ নাচ, সুনীল-শক্তির জলপুলিশি জল্পনা, পার্বতী-সন্দীপনের রেড লাইট এলাকার আপাত বাতিল খুনসুটি থেকে মহীনের ঘোড়াগুলির শো-এর অপার উন্মত্ততা। স্বল্প আলোচিত বারীন সাহাকে দিয়েছেন মোজেসের ভূমিকা, বাতিল করে দিয়েছেন সত্যজিৎ রায়ের শিল্প উল্লাস। প্রশ্ন দাগিয়েছেন খালেদ চৌধুরীর মঞ্চচিত্রণকে। এইভাবেই ঝরা পাতায় এসেছে প্রৌঢ়ত্বের রঙ, এসেছে ছকভাঙা গোলা বারুদ, কল্পনার ভিসুভিয়াস, আর সেখানে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ঝরা সময়ের কারিগর—দীপক, গৌর, গৌতমের ত্রিভূজের পিথাগোরাস তিনি এই ভাবেই এঁকে দিচ্ছেন জীবন সমুচয়। বল্পাহীন ক্ষয় সেঁচে আনেন জীবনের অমৃত। কালের রাখাল হিরণ মিত্র আমাদের করে তুললেন এই ঝরা সময়ের অংশীদার।
হিরণ মিত্র
জন্ম পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়গপুরে। পঞ্চাশে বড় হওয়া চারপাশে রেল চৌহদ্দির বাইরে বন জঙ্গল, খেত খামার, আদিবাসী গ্রামে। রঙ তুলি কাগজ কলম নিয়ে ঘুরে আর কাদা জল ভেঙ্গে কেটেছে পঞ্চাশের দশক। ষাটের শুরুতে কলকাতায় সরকারি চারুকলা বিদ্যালয়ে শিল্পশিক্ষা। বিবাহ, সন্তান। আশি, নব্বই, দুই হাজারে অজস্র বিদেশ ভ্রমণ, প্রদর্শনী। উপস্থাপনা শিল্প ও চিত্রশিল্পে সদা ব্যাস্ত। দুইহাজার পাঁচ সাল থেকে ‘আর্ট বর্ডার লাইন’ নামক ব্রিটিশ সংস্থার চুক্তিবদ্ধ শিল্পী।
আলোচনা সমালোচনাগুলি পড়তে ছবির উপর ক্লিক করুন।