১ম ব্লার্ব
বাঙালির পছন্দের লব্জে যে সব শব্দবন্ধ স্থায়ী আসন পেতেছে, বাজার হাট তার মধ্যে অন্যতম। আসলে যে জাতের সেরা কবি মনে করেন বাসনার সেরা বাসা রসনায়, সেই নোলাসর্বস্বদের নিজস্ব খোরাকের তাগিদে হাটে বাজারে দৌড়োনোটা ভবিতব্য বিশেষ। যতই জোর করে হাট আর বাজার একসঙ্গে উচ্চারণ করা হোক না কেন, তারা জাতে আলাদা। নানাদিক খতিয়ে দেখে তবেই জোব চার্নক ডেরাডান্ডা গেড়ে বসেছিলেন কলকাতায়। সুতানুটির সুতোর হাট, বাজার কলকাতার বিরাট বাজার আর গোবিন্দপুরের চালের হাট ছিল এই আকর্ষণের প্রধান কারণ। কল্যাণী দত্তের ফরাসি পিসিমা বলতেন, পিসো নাকি তাঁকে বলেছিলেন কলকাতায় বাবুদের কেনাকাটার জায়গা মোটে তিনটে। আরমিনের, লেডেলার আর আন্ডেরসেনের দোকান। আর পিসিমার চন্নননগর পুরোটাই একটা ঝলমলে বাজার, কেবল পয়সা ফেলতে জানলেই হবে। বাজার গেরস্থের স্বপ্ন। হারানো স্মৃতির সন্ধানে গেরস্থ সারা বাজার পায়ে হেঁটে ঘুরতে থাকেন। বাজার আগুন। সেই আগুনে তার পা পুড়ে যায়। কিন্তু বাজার কেবলই অর্থনীতির কেঠো শরীর আর কিছু নেই? যে ঋতুপরিবর্তন পায়রার খোপের ফ্ল্যাটে অধরা সেই বালিকার রঙিন ফ্রক মেলে বসে থাকে আমাদের বাজারসফরের পথে পথে।
আর আসে স্মৃতি। আমাদের যৌথ জীবনের স্মৃতি, ফিরে ফিরে আসে বাজারে। কোনও কোনও বিশেষ জিনিস পুরনো হারানো মানুষকে মনে করিয়ে দেয়। বরুণহাটের বাজারের মতো, হুলোমেনির বাজারের মতো হরেক গল্পের বাজার হারিয়ে যায়, তার চিহ্নটুকু না রেখেই। দিনের শেষে বিকিকিনি সাঙ্গ হলে এভাবেই বাজারের রেশটুকু থেকে যায়। ভাঙা ঝুড়ি, বাতিল সবজি, ও ঘরফেরা মানুষে।
২য় ব্লার্ব
হুতোম ১৮৬১ সালে শোভাবাজারে রাজাদের ভাঙ্গা বাজারের গল্প লিখেছিলেন। কেমন করে মেচুনীরা প্রদীপ হাতে করে ওঁচা পচা মাচ আর লোনা ইলিস নিয়ে ক্রেতাদের “ও গামচা কাঁদে ভালো মাচ নিবি?” ও “খেংরাগুপো মিনসে চার আনা দিবি” বলে আদর কচ্চে— মধ্যে মধ্যে দু একজন রসিকতা জানাবার জন্যে মেচুনী ঘাঁটিয়ে বাপান্ত খাচ্চেন। তারও একশো ছত্তিরিশ বছর পরে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তার বাজার সফরে লিখেছেন বিরজা মহান্তির কথা। বেহালার নতুন বাজারে শ্রীমতী বিরজা তাঁর স্বামীকে বঁটিতে বসিয়ে কাটাপোনার খদ্দের সামলান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। বিরজার সঙ্গে খদ্দেররা তাঁদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। বিরজাই বলে দেন, আজ মাছের তেল নেবেন না দাদাবাবু। বর্ষা পড়ুক। আমি নিজে তেল বেছে দেব।
বাজার ইতিমধ্যে তার প্যারাডাইম শিফট করেছে। মেয়েদের ভূমিকা কেবল আর ‘প্রদীপ হাতে বাজারের মেচুনী’ নয়, বাজারের ক্রেতার একটা বড় অংশ এখন মেয়েরাই। হুতোম, শ্যামল ছাড়িয়ে মেয়েদের হাতের কলমে প্রমাণ মিলেছে এই সংকলনে। এখন অপিসফেরতা ভ্যানিটিব্যাগের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে বাজারের ব্যাগ। ব্যাগে উঠে আসে যা কিছু প্রয়োজন সংসারে। কেবল তাই নয়, যা খেতে সাধ যায়। ঘরে এনে কোটবার সময় নেই বলে এই দশভুজাদের নিস্তার দিতে তেমনই সব আনাজপাতি, কচুশাক, থোড় মোচা কুটে দিয়ে বিক্রি হয় আজকাল। দীর্ঘকাল গৃহিণীদের সমান্তরাল অর্থনীতি বেঁচে ছিল এক অদ্ভুত বার্টার সিস্টেমে। পুরনো শাড়ি দিয়ে কেনা বাসন বা নতুন শাড়িতে। কত্তামশাইরা যার খোঁজ রাখেননি কোনোদিন। কিন্তু আজকালকার বাজার-অর্থনীতিতে মেয়েদের অবদান নিয়ে নিশ্চয়ই অ্যাকাডেমিক কথাবার্তা শুরু হবে এই ভ্রমণ বৃতান্ত সাঙ্গ হলে।
সমালোচনাগুলি পড়তে ছবির উপর ক্লিক করুন