র্যাডক্লিফের লাল কলম বাংলা ও পাঞ্জাবের লক্ষ লক্ষ মানুষের কপালে এক নিমেষে দেগে দিয়েছিল দেশভাগের ক্ষতচিহ্ন। হলোকস্টের পর বৃহত্তম এথনিক ক্লিনজিং এর ঘটনা ঘটে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে। বসনিয়া হার্জেগোভিনাতে মেয়েদের ঢালাও ধর্ষণের পরে ১৯৯৪ সালে নারীবাদী বিশ্লেষক Stasa Zajovic লেখেন ‘the female womb becomes occupied territory’। একই ঘটনা ঘটেছিল পূর্বপাকিস্তান, অধুনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইতেও। বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার লক্ষ্যে খানসেনাদের অত্যাচার, সঙ্গে কতিপয় দালালের বিভীষণ শিবারবে আবিল হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের জয়গাথা।
জন্মসূত্রে নারী পরিযায়ী। গার্হস্থ্য জীবনে মানবাধিকারের অভাব মেয়েদের জীবনকে অহরহ পীড়া দেয়। শ্বশুরের ভিটেয় এমনিই সীমিত অধিকার; সেই স্থিতিশীলতাটুকুও বিঘ্নিত হয়ে পড়ে রাষ্ট্রশক্তির তাড়নায়। দেশভাগ, স্বাধীনতাযুদ্ধ—রাষ্ট্রবিপ্লবে মেয়েদের জীবনে নেমে আসে করাল ছায়া। তিরিশ লক্ষ শহীদ, চারলক্ষেরও বেশি ধর্ষিতা মেয়ের চোখের জলে মুক্তি কিনেছে স্বাধীন বাংলাদেশ।
এই বই কেবল সেই বিপুল বিজয়কে ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার ক্ষুদ্র মুকুরে দেখার প্রচেষ্টা। ষোলটি সাধারণ মেয়ের অসম্ভব জবানবন্দীর এই দলিল সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন ঝর্ণা বসু। ভিটেমাটিহীন, আতঙ্কগ্রস্ত শরণার্থীদের এই কাফেলায় সংযুক্ত হয়েছে অকালপ্রয়াত চিত্রগ্রাহক কিশোর পারেখের মুক্তিযুদ্ধকালীন তোলা আলোকচিত্রসমূহ।
ঝর্ণা বসু
জন্ম ১১ অগস্ট ১৯৫২ পূর্ববঙ্গের পূর্বতন খুলনা জেলার বাগেরহাটে। মনমোহিনী গার্লস স্কুলে পড়াশুনো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবাকে খুন হতে দেখেন রাজাকারদের হাতে। অতঃপর কিছুকাল দেশে থাকার বৃথা চেষ্টা করে শরণার্থীদের দলে নাম লেখানো। পরে দেশ স্বাধীন হলে ফিরে যাওয়া প্রাণের বাংলাদেশে। সেখানে প্রফুল্লচন্দ্র মহাবিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ অন্তে বাগেরহাট গার্লস কলেজে অধ্যাপিকা হিসেবে যোগদান। ফের দেশছাড়া হওয়া ১৯৭৮ সালে। বর্তমান আবাস উত্তর ২৪ পরগনার বারাসাত। এখনও অন্তরে বাহিরে শুধু বাংলাদেশ। সম্পাদিত বইয়ের তালিকায় রয়েছে ‘অবরুদ্ধ অশ্রুর দিন’, ‘বিপন্ন কালের ভেলা’, ‘হৃদয়ের টুকরোয় গাঁথা’ ইত্যাদি। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গবেষণামূলক বই ‘বঙ্গে নারী শিক্ষার প্রবর্তক কালীকৃষ্ণ মিত্র, যুগ ও সাধনা’।
আলোচনা/ সমালোচনা
School of Humanities | Netaji Subhas Open University এর অন লাইন জার্নালের একটি চমৎকার বিভাগ BENGAL PARTITION REPOSITORY
http://www.cltcsnsou.in/book-review/
এখানকার দ্বিতীয় বইটি ৯ঋকাল বুকসের। নীচে পুরোটাই কেটে লাগালাম। ধন্যবাদ সমালোচক ও পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে।
ভাগফল ৭১ মেয়েদের কথা
উৎসর্গ : যুদ্ধ,দাঙ্গা, দেশভাগ আর রাষ্ট্রবিপ্লবে বিপর্যস্ত সকল মা’কে
সঙ্কলন ও সম্পাদনা : ঝর্ণা বসু
আলোকচিত্র : কিশোর পারেখ
প্রচ্ছদ : রঘু রাই
প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০১৮
প্রকাশক : লিরিক্যাল বুকস
মূল্য : ৪৫০ টাকা
একটি বই টেবিলে থাকলে যদি সেখানে উপস্থিত পাঁচ জনের দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষিত হয়, বইটির বিষয় বা বৈভব না জেনেও, তখন বোঝা যায় বইটির প্রকাশে বহু মানুষের যত্নের ছাপ আছে। প্রচ্ছদ ও নাম যে কত গুরুত্বপূর্ণ তাঁর প্রমাণ এই বইটি। সম্পূর্ণ সাদা-কালোয় চোখ টানা প্রচ্ছদটির অর্ধাংশ ঘিরে রয়েছে ভাঙ্গা-চোরা স্বপ্ন ও সংসারের টুকরো আর ভবিষ্যতের অনন্ত জিজ্ঞাসা ভরা দৃষ্টি নিয়ে শরণার্থী শিবিরে শায়িত এক নারীর আলোক চিত্র। প্রচ্ছদের ওপরে গ্রন্থ নাম ‘ভাগফল ৭১ মেয়েদের কথা’ । প্রচ্ছদটি এতই বাঙ্ময় যে, গ্রন্থের বিষয় আলাদা করে বলার প্রয়োজন হয় না।
১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সেখানকার মেয়েদের জীবনে নেমে আসে যে করাল ছায়া নেমে আসে, চার লক্ষেরও বেশি মেয়ের জীবন, যৌবন, স্বপ্ন ও চোখের জলের বিনিময়ে যে মুক্তি কিনেছে বাংলাদেশ, সেই বিপুল বিজয়ের মুক্তিযুদ্ধকেই নারী অভিজ্ঞতার ক্ষুদ্র মুকুরে দেখার প্রচেষ্টা এই গ্রন্থটি। মুক্তিযুদ্ধে যাতনার শিকার ষোলটি সাধারণ মেয়ের হাড়-হিম করা জবানবন্দীর দলিল এই সঙ্কলন। সম্পূর্ণ অন্য মাত্রার এই গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন ঝর্ণা বসু।
পুর্বতন পুর্ববঙ্গের খুলনা জেলার বাগেরহাটের কন্যা ঝর্ণা বসু ;১৯৭১-এ নিজের চোখে বাবাকে খুন হতে দেখেন রাজাকারদের হাতে। অতঃপর শরণার্থী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন । শিক্ষান্তে বাগেরহাট গার্লস কলেজে পাঠদান । বর্তমান আবাস উত্তর ২৪ পরগনার বারাসাত । তাঁর সম্পাদিত ‘অবরুদ্ধ অশ্রুর দিন’, ‘হৃদয়ের টুকরোয় গাঁথা’ প্রভৃতি গ্রন্থে বারংবার ফিরে আসে বাংলাদেশে বিপন্ন নারীদের অশ্রু ও সংগ্রাম ।
সমগ্র বইটি ষোলজন নারীর অসহায়তার জবানবন্দী। বইটির অঙ্গ সজ্জা হিসেবে রয়েছে পাতায় পাতায় অকাল প্রয়াত চিত্রগ্রাহক কিশোর পারেখের মুক্তিযুদ্ধকালীন তোলা সাদা-কালো আলোকচিত্র। এই আলোকচিত্রগুলি লেখার সঙ্গে সংগতি রেখে ‘৭১-এর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ও মেয়েদের ভয়ঙ্কর ভাঙনকে তুলে ধরে । যে ষোলজন মেয়ের জবানবন্দী নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে দুজন মুসলিম ও বাকি সবাই হিন্দু পরিবারের মেয়ে। এই ষোলোজন নারীদের সংকলক বেছে নিয়েছেন সমাজের সর্বস্তর থেকে। চার সন্তানের জননী গ্রামের গৃহবধূ ইলারাণী ঘোষ আছেন। ‘সারা বছর ঘর সংসার করা মেয়েলোক’ কিরণময়ী মণ্ডল । আবার শিক্ষক শ্বশুর ও শিক্ষক স্বামীর শিক্ষিত বধূ আশালতা হালদারও আছেন। রোখসানা দিল আফরোজ ছিলেন চিকিৎসক পিতার সন্তান। সংস্কৃতিমনস্ক, শিক্ষানুরাগী, নাট্যপ্রেমী পরিবারের সন্তান। এইসব ভিন্ন ভিন্ন পরিবার-পরিবেশের মেয়েরা যে জবানবন্দী দিয়েছে তা কম বেশি একই নির্মমতা , নৃশংসতা ও অসহায়তার দীর্ঘশ্বাসে ভরা । সংকলনে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে ঝর্নারানি বিশ্বাস ও অনুরূপা ভৌমিকের জবানবন্দী । ঝর্নারানী বিশ্বাস শিক্ষিত ও বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনার সূত্রে নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত করেছেন আরও নানাজনের অভিজ্ঞতার কাহিনি । তাঁর লেখার মধ্যেই আমরা আরও তিনজন মহিলার কথা চিঠির বয়ানে পাই । অনুরূপা ভৌমিক পরিবার ও সমাজের বহু প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে অকাল প্রয়াত মায়ের অনুপ্রেরণায় বরিশাল উইমেনস কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হন ও স্কুল শিক্ষিকা হিসশবে কাজে যোগদান করেন । স্বাধীন বাংলাদেশেও বাকি আর সমস্ত মহিলাদের মতোই তাঁকে অসম্মান ও সংগ্রাম হাতিয়ার করে লড়তে হয়েছে । ১৯৮৩ সালে তিনি আরও একবার তাঁর প্রিয় জন্মভূমিতে নির্মমভাবে আক্রান্ত হন। স্বাধীনতার পরেও এইসব মেয়েরা অনেকেই নিজের দেশে বসবাস করতে পারেন নি বা ভয়াবহ আতঙ্কে দিন যাপন করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ এই নারীদের জীবনে কোন নতুন সূর্যের আলো এনে দেয় নি।
এই বইয়ের সবচেয়ে বড় গুরুত্ব ইতিহাসের নবনির্মাণে । যেকোন দেশের যেকোন যুদ্ধের মত মুক্তিযুদ্ধ শুধু ৪৭ থেকে ৭১এর রাজনৈতিক ঘটনাবলী নয় । যেকোন যুদ্ধের ইতিহাস শুধু রাজনীতির চাপান উতোর , নেতৃত্বের হত্যা বা প্রতিহত্যার ঘটনা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না । যারা প্রান্তবাসী মানুষজন, তারও প্রান্তিক নারী , যারা যুদ্ধে বিজয়ীর লুটের মাল হিশেবে গণ্য হয় , তাদের চোখের জলের নোনা দাগ, যুদ্ধের এক সমান্তরাল ইতিহাস ও আলেখ্য রচনা করে । ঝর্ণা বসু সেই আলেখ্যকেই সুসম্পাদিত করেছেন।
এই গ্রন্থের আরও একটি বড় সম্পদ এর কথন ভঙ্গি। পৃথক পৃথক পরিবার ও পরিবেশ থেকে উঠে আসা মেয়ের ভিন্ন আত্মকথন ভঙ্গি ও ভাষা প্রায় একই ধরণের বিবরণকেও ভিন্ন মাত্রা দেয়। আর উল্লেখ না করলেই নয়, প্রতিটি আত্মকথনের শেষে মুক্তিযুদ্ধের কবিতার অংশত। প্রতিটি মেয়ের অভিজ্ঞতার যন্ত্রণা ও অশ্রুবিন্দু জমাট হয়ে যেন শেষে কবিতার অংশটি রূপ পাচ্ছে । ছবি ও কবিতা দিয়ে সাদা-কালোয় সাজানো যাতনার এই চাপ চাপ অন্ধকার যেন সিনেমার রিলের মত একের পর এক আমাদের চোখের সামনে জীবন্ত ছবি হয়ে ওঠে ।
ড অনিন্দিতা দাশগুপ্ত
এসোসিয়েট প্রফেসর, বাংলা বিভাগ, গুরুদাস কলেজ,
aninditadasgupta72@gmail.com

গভীর নির্জন পথের গদ্য পদ্য প্রবন্ধ ১, সম্পাদনা- অংশুমান কর, ২০২১
GADYAPADAYAPRAPANDHA_vol1-1PDF Embedder requires a url attribute GADYAPADAYAPRAPANDHA_vol1-2
GADYAPADAYAPRAPANDHA_vol1-3
GADYAPADAYAPRAPANDHA_vol1-4
GADYAPADAYAPRAPANDHA_vol1-5
GADYAPADAYAPRAPANDHA_vol1-6
GADYAPADAYAPRAPANDHA_vol1-7
