রসনার নাগপাশে রুটম্যাপ আঁকা। নিত্য মিশে যান নতুন মানুষদের সঙ্গে, নতুন ঋতু সমাগমে, অন্য স্থানে, অন্য কোনওখানে। অরুণাচলে ইদু মিশমিদের ‘রেহ’ উৎসবের রক্তের কেক, শত সহস্র ছাগবলির ক্ষীরগ্রামের মেলায় ছাগ মাংসের ভোগ, বিনসারের নিরামিষ ডিম, স্টার অ্যানিসের কেয়ূরে সাজানো কেরালা। কালিকটের শঙ্করণ বেকারি, গোয়ার নিজস্ব মিষ্টি ব্যাবিংকা, শান্তিনিকেতনের পৌষমেলার তাজ ‘মথুরা কেক’, কেরালার অচিন হিলস্টেশন ভাগামন, মশলার জঙ্গল সফরে নিজেকে হারিয়ে খুঁজে পাওয়া বুর্জোয়া খাদ্য সংস্কৃতির শিখর চূড়া তেল্লিচেরির এক সামান্য সি-ফুডে— কিং ফিশ উইথ ম্যাংগো কারির সুবাস যেন ঢেউ খেলে যায় সাদা পাতায় কালো অক্ষরে। এভাবেই বই জুড়ে টানানো স্বাদ স্মৃতির সামিয়ানা। আছে সারা দেশের নানা কালীবাড়ির ভোজের খতিয়ান, আন্দামানের চিড়িয়াটাপুতে কাচকলানি আবিষ্কার, মানালির মাংস দিয়ে সিড্ডু, হরিদ্বারের জ্বালাপুর চকবাজারের ‘সূর্য কা দাল’ রহস্য। ঘুরে ট্যুরে বেড়াতে গিয়ে ধরা পড়েছে দিন বদলের পালা। দার্জিলিং পাহাড়ের রুরাল ট্যুরিজিম ও ভিলেজ হোম-স্টে কেমন পালটে দিয়েছে স্বাদের আহ্লাদীপনা। স্বাদ-চিত্রে এসেছে গোয়ার সেমি হিল স্টেশন ফার্মাগুড়িতে জড়িবুটির আচারের দেশ, কখনও বিশাখাপত্তনমের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়েছেন লেটুস পাতার আচারের বিচারে। মাধ্যমিক শেষে বাবা মন্ত্র দিয়েছিলেন বেরিয়ে পড়তে। হাতে সামান্য কিছু টাকা পয়সা আর বৈচিত্রের বেলুনের মধ্যে ঐক্যের হাওয়া ভরা ‘ভারতবর্ষ’ নামের এক সুবিশাল দেশ। নানা ভাষা, নানা পরিধানের মতো অধরা খাদ্য সম্ভারে খুঁজে ফেরা। এই পথের শেষ নেই।
এই বই ফুড ট্যুরিজম চর্চার নতুন দিগন্ত। বইতে সংযোজিত হয়েছে উত্তরবঙ্গের হোম-স্টে সহায়িকা, সারা ভারতের জলখাবারের হদিশ ও কলকাতার ফুচকাওয়ালাদের তুলনামূলক স্বাদ বাহারের তালিকা। সারাদেশের হৃদয় খুঁড়ে বেদনা সংগ্রহ করে চলেছেন যে ভ্রমণিক অনাবিল কিশোরবেলার মৌলিক সুগন্ধটুকু পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেননি। আছে ‘ফেরিওয়ালার ডাক ও রাস্তার আওয়াজ’, খেজুর রসের দত্তি, বুড়ির চুলের মেঘ ওড়ানো কিছুমিছুওয়ালা, কুলফিমালাই বরফওয়ালার ঘণ্টা বেজেছে সারা রুটম্যাপ জুড়ে। নিত্য নতুন অজানা খাবার ও মানুষ আবিষ্কারের বেবন্দেজ রাস্তার বাঁকে লুকিয়ে আছে ছোটবেলার ছোট ছোট নুড়ি-পাথর-কিঞ্চিৎকর সঞ্চয়গুলি। সারা দেশ জুড়ে হিল্লোল উঠেছে স্বাদ তরঙ্গে, টাকরায় টঙ্কার।
অরুণাভ দাস
জন্ম ১৯৭০ সালে। কর্মজীবন শুরু ১৯৯২-এ ‘ভ্রমণ’ পত্রিকার সাব-এডিটর হিসাবে। ১৯৯৬-৯৭ সালে ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে লেকচারার। ১৯৯৭ সাল থেকে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর অধ্যাপক। ইতিহাস ছাড়াও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্তরে অনেক বছর ধরে ভ্রমণ ও হিমালয়চর্চা বিষয়ে পড়ান। গবেষণার বিষয় ঔপনিবেশিক দার্জিলিংয়ের অর্থনীতিতে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের ভূমিকা। ভ্রমণ বিষয়ে কয়েক হাজার ফোটো-ফিচার লিখেছেন দেশ-বিদেশের পত্রিকায়। লিখেছেন ছোটগল্প ও উপন্যাস। প্রকাশিত ৩৬ টি বইয়ের মধ্যে ২৯টি ভ্রমণকথা। ভ্রমণআড্ডা সংস্থা থেকে সারা জীবনের লেখালিখির জন্য ভ্রমণ-সম্মান ২০১৪ ও সিকিম এক্সপ্রেস সংবাদপত্র থেকে ট্রাভেল রাইটার অব দ্য ইয়ার ২০১৬ এবং নবাঙ্কুর পত্রিকার সাহিত্য সম্মান ২০১৭ প্রাপ্ত। গল্প লিখেছেন দেশ, সানন্দা, উনিশ কুড়ি, বর্তমান রবিবার, সাপ্তাহিক বর্তমান, ফেমিনা, শিলাদিত্য ইত্যাদি পত্রিকায়। ছোটদের গল্পের বই একটি, ‘মন খুশির কোলাজ’ সৃষ্টিসুখ থেকে প্রকাশিত। লিখেছেন শুকতারা, আনন্দমেলা, কিশোরভারতী, ছেলেবেলা, আমপাতা জামপাতা ইত্যাদি ছোটদের পত্রিকায়।
লেখকের ছবি- শুভায়ু চট্টোপাধ্যায়
আলোচনা বা সমালোচনাগুলি পড়তে ছবির উপরে ক্লিক করুন।