শ্মশান। অহরহ মৃত্যুর ছায়াপাত। স্বজন হারানোর কান্না। ডোম, মাতাল, চোর, সাধু, পুলিশ, যৌনকর্মী, শ্মশানকালীর পুরোহিত। গুটিকয়েক চা-পান-ভাজাভুজির গুমটি। রাত হলেই জেগে থাকা গুমটি ঘরে মেলে দেশি-বিলাতি হরেক মদ, চুল্লুর পাউচ, শুকনো নেশার সরঞ্জাম, গাঁজার কলকে। আঁধার সয়ে এলে পরিস্ফুট হয় শ্মশানের আরেক নিভৃত ছবি। লাগোয়া ডেরায়, ছোট ছোট দরমা দেওয়া ঘরে মায়াবী কায়া ছায়ার তান্ত্রিকদের বসতি। ভৈরবী, অঘোরী সাধকদের পাশাপাশি রয়েছেন ভৈরবী, অঘোরিনী শ্মশান সাধিকা। সে এক অচেনা জীবন। অপঘাতে মরা শরীরের ওপর বসে চলে শব সাধনা। তন্ত্র সাধনার নির্দিষ্ট তিথিযোগে বসে ভৈরবী চক্র। হোম – ক্রিয়া – নানান সব তান্ত্রিকী আচরণ। ভৈরবী মা শ্মশানকালীর ভোগ রান্না করেন। ভৈরব ঠাকুর গল্প করেন জাগ্রত সব দেবীপীঠের, শ্মশানকালীর থানের। সেখানে সিদ্ধ তান্ত্রিকদের আনাগোনা। কেউ ধ্যানসিদ্ধি দিয়ে অচেনা মানুষজনের ভেতর মনের কথা গড়গড়িয়ে বলে দিতে পারেন। আছে বশীকরণ। মারণ – উচাটন— নানান সব শ্মশান চিকিৎসা। কাশ্মীরীয় তন্ত্রের আচার্য উৎপলের শিবদৃষ্টি পুথির পাঠ হয় মানুষ পোড়া চুল্লির আলোয়। ছিটকে এসে পড়ে পোড়া মানুষের মাংসের টুকরো। মায়ের প্রসাদ জ্ঞানে তান্ত্রিক সাধক মুখে তোলেন নর মাংস।
সোমানন্দ অবধূত জানান শব্দবিদ্যার কথা, যা দিয়ে ভাল হয় রোগ। পথ্যাপথ্যের উপর জোর দেন প্রবৃদ্ধ তান্ত্রিক ব্রহ্মানন্দ বাবা। পারদ চিকিৎসা, আয়ুর্বেদ চিকিৎসার পাঠদানের ভেতর তৈরি হয়ে ওঠে বিচিত্র সব রান্না। কামাখ্যা – নীলগিরির পাহাড় চূড়ায় ভৈরবী মা তৈরি করেন নারকেল আর চাল সহযোগে ঘিলাপিঠা। ভুবনেশ্বরী মায়ের ভোগ হয় এই পিঠায়। মলুটি শ্মশানকালীর ভোগ হয় যোগমায়া মায়ের হাতে তৈরি ছাতুর রুটি ও ধনে পাতার রসাতে। ভোগের জন্য রান্না হয় গুগলি— পোয়াল, মাসকলাইয়ের ডাল, লাফা শাক ভাজি, মানকচুর তরকারি। কালীশিলাতে আদিবাসী তান্ত্রিকেরা ধেড়ে-ইঁদুর, বনমোরগ দিয়ে ভোগ দেন মায়ের। তৈরি হয় চুনো মাছের ভাপানি, তেঁতুল শাঁসের অম্বল, মুসুর ডালের ভাত, পাতপিঠার মতন হরেক রকম গ্রামীণ রান্না। উনুনে রান্না করতে করতে ভৈরবী মা ডাক – ডাকিনী – ভূত – প্রেতের কথা বলতে থাকেন। ভৈরব ঠাকুর নরবলি নিয়ে কথা এগোন — নানান সব অলৌকিক গল্পগাছা, আত্মার আসা – যাওয়া, শ্মশান চিতায় মরা মানুষের উঠে বসা। শ্মশান ডেরায় পঞ্চমকারের মদ তৈরি হয়। সর্যে মধুর মদিরা, রসবন্ধ, ঘোলমদ, তালমদ, দেবীঅর্চনার গুড়ের সুরা, আতপ চালের কারণবারি দিয়ে গভীর রাতের শ্মশানে চলতে থাকে তন্ত্রের সপর্যা। এ এক বিচিত্র জগৎ, লোকচক্ষুর আড়াল নেওয়া বিচিত্র মানুষজনদের সাধন জীবন, হাসি-কান্না, চাওয়া-পাওয়া, লোভ-ব্যভিচার মেশা বাঙালির শ্মশান সাধনার সরেজমিন অভিজ্ঞতার বৃত্তান্ত—লেখকের শ্মশানবাসের হাড় হিম করা ছমছমে ভোজন ও ভজন কথিকা।
সোমব্রত সরকার
প্রাকৃতজনের আচার – কৃষ্টি – সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে ইতোমধ্যেই ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। গ্রামবাংলার বাউল, ফকির, বৈরাগী, দরবেশ, ভৈরবী, সাধু, অঘোরী, কাপালিক, সহজিয়া সাধকদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। গ্রামাঞ্চল ঘুরে সংগ্রহ করেছেন লোকগান ও লোকসাধকদের ভাষা। কলকাতা, ঢাকা, ত্রিপুরা মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ত্রিশ। ভারত সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রকের ফেলোশিপ নিয়ে গবেষণা করেছেন বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে। দুই বাংলা জুড়ে তাঁর লেখা বইগুলো বিদগ্ধ মহলে আলোচিত।
লেখকের ফোটো- শুভ মিত্র
আলোচনা বা সমালোচনাগুলি পড়তে ছবির উপরে ক্লিক করুন।