বাড়ির দুইদিক ঘিরে এই বস্তি। এক একটা ঘরে গোটা পরিবার। এক চিলতে লাগোয়া বারান্দাতেও থাকে কেউ কেউ। একটাই স্নানঘর একটাই শৌচাগার। আছে এক বারমেসে শিউলির গাছ, সময় অসময় না বুঝেই ফুল ঝরায় অকাতরে। এলাকা ঘিরে থাকা কোন্দল আর অশান্তির মেঘ বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের এক বালিকা দেখে তার তিনতলার সিঁড়িঘর থেকে। সবচেয়ে বেশি ঝগড়া হয় জল নিয়ে। জলের খুব অভাব। ভোর চারটে থেকে ভাঙা বালতি, ফাটা মগে নিজের উপস্থিতি জানানো। ভাঙা রাখাই দস্তুর। আছে চুরি যাওয়ার ভয়। গলি পার হলেই বড় রাস্তা। অনেক লোকের চলাচল। বস্তির হলুদ টিমটিমে আলো আসে না গলি পর্যন্ত। ছোটদের খেলা ছিল সেই আঁধারিতে নকল টাকা ফেলে রাখা। কেউ নিচু হয়ে তুলতে গেলেই হাততালি দিয়ে ওঠা। বাড়ির শাসনের গণ্ডি অতিক্রম করে সে কেবলই মিশে যেতে চায় বস্তির লোকেদের সঙ্গে। মেয়েটি মনেমনে সেই বস্তিরই একজন।
নিত্য অশান্তি অতিক্রম করেও নিম্নবিত্ত যাপনে মানুষের পারস্পরিক আত্মীয়তা চোখে পড়ে তার। কারও কারও অবশ্য বিয়ে হত অনেকবারই। কিন্তু টিকত না। কানাকানি হত, স্ত্রীর সঙ্গে এক বিছানায় শোয়া সহ্য করতে পারে না তার মা। বাথরুমের খোলা অংশ দিয়ে সে দেখেছে ছেলেটিকে হস্তমৈথুন করতে। নিজের ঋতুচক্র শুরু না হলেও জাগর্তি এসেছে বন্ধুদের মারফত। এই আত্মস্মৃতিকথার কৌমুদী ছড়িয়ে ধ্বস্তি এলাকা জুড়ে— অত্যাধিক পানদোষে বারবার ঘরছাড়া হওয়ার পরেও তেলেভাজার দোকানের বাঁটুল রোজ সন্ধেয় ফিরত মদ খেয়ে, পাঁঠা কাটা বিনোদ একদিন আর কিছুতেই খাঁড়া তুলতেই পারল না শুকিয়ে মারা গেল কোন এক অভিশম্পাতে, গীতার বাবাকে বাজারের মধ্যে এক ষাঁড় শিং দিয়ে পেট ফুটো করে দিল, অতি বড় সুন্দরী বুড়িদির বিয়ে হল না কিন্তু বোনের স্বামী এসে মাঝেমাঝেই রাত্রে থেকে যেতে লাগল, নিয়মিত ছেলে ভুলিয়ে ঘরে নিয়ে আসা মিনতি একদিন দেখল বস্তির সমস্ত ঘরের ছাদ খুলে নিয়ে গেছে মালিকের ছেলে। উচ্ছেদের ঢেউতে বারমেসে শিউলির গাছও কাটা পড়ল একদিন।
অহনা বিশ্বাস
কবি, কথাসাহিত্যিক এবং চিত্রী। জন্ম ১৯৭০ সালের ১৬ মার্চ আসানসোলে। শিক্ষা বিশ্বভারতীতে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার ওপর তাঁর গবেষণা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনা করেন বর্ধমান শহরের বিবেকানন্দ কলেজে। দেশ, বর্তমান, প্রতিদিন প্রভৃতি বড় কাগজ ছাড়াও প্রায় সব প্রতিষ্ঠিত বাংলা পত্রিকায় তার কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিমা মিত্র স্মৃতি পুরস্কার, বাংলা আকাদেমির সোমেন চন্দ পুরস্কার, ভরতব্যাস পুরস্কার, নিখিলবঙ্গ বাংলা সাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি নানা পুরস্কারে ভূষিত। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে পেয়েছেন শিক্ষারত্ন পুরস্কার।
শান্তিনিকেতনের পাশে একটি আদিবাসী গ্রামে বাস করেন এবং গ্রামীণ সংস্কৃতি রক্ষার কাজ করে চলেছেন নিরন্তর।
ফোটো- অহনা মজুমদার
আলোচনা বা সমালোচনাগুলি পড়তে ছবির উপরে ক্লিক করুন।